
রাজধানীর মহাখালীতে ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ভোরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ১২-১৩ বছর বয়সী তিন শিশুর। দুর্ঘটনার পর খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশ। এরপর প্রায় তিন সপ্তাহ লাশগুলো মর্গে পড়ে থাকলেও নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। অবশেষে লাশগুলো অজ্ঞাত বা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে জনকল্যাণমূলক সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। ঘটনার দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও নিহত ওই শিশুরা অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।
শুধু এই তিন শিশুই নয়, তাদের মতো আরও হাজারো মানুষ মৃত্যুর পর অজ্ঞাত হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই জীবদ্দশায় ‘ভাসমান’ পরিচয়ে রাস্তাঘাটে কিংবা খোলা স্থানে জীবন কাটাতেন। রোগ-শোকের পাশাপাশি অপুষ্টিতে ভুগে অথবা বয়সজনিতসহ বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর পর পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে দেয় দাফনের জন্য। এছাড়াও হত্যাকাণ্ডের শিকার কিংবা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত অনেক মানুষের পরিচয় উদঘাটিত না হওয়ায় তাদের শেষ বিদায় হচ্ছে ‘অজ্ঞাত’ কিংবা বেওয়ারিশ হিসেবে।
জানা গেছে, ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ২ হাজার ১৩৭টি অজ্ঞাত লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৪৬৫টি অজ্ঞাত লাশ দাফন করেছে সংস্থাটি। যার মধ্যে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ২৪২টি লাশ। আর বাকি ২২৩টি লাশের ঠিকানা হয়েছে রায়েরবাজার কবরস্থানে। ২০২২ সালে এই দুই কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ৪৪৩টি বেওয়ারিশ লাশ। এছাড়া ২০২৩ সালে জুরাইন কবরস্থানে ২০৪টি ও রায়েরবাজার কবরস্থানে ২৮২টি মিলিয়ে মোট ৪৮৬টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে আঞ্জুমান মফিদুল। একই বছরে পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে ৪টি অজ্ঞাত মৃতদেহ সৎকার করেছে তারা। ২০২৪ সালে শুধু রায়েরবাজার কবরস্থানে ৫৫৮টি অজ্ঞাত মৃতদেহ দাফন করে সংস্থাটি, আর পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে সৎকার করা হয়েছে ২টি মৃতদেহ। ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম ৪ মাসে রায়েরবাজার কবরস্থানে ১৮১টি অজ্ঞাত মৃতদেহ দাফন করা হয়েছে।
এসব অজ্ঞাত লাশের বেশিরভাগই ভাসমান মানুষের বলে জানিয়েছে পুলিশ। আর বাকিরা হত্যার শিকার কিংবা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে ৩৭টি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে ২৫ জন পুরুষ, ৭ নারী, ২ শিশু ও ৩ জন নবজাতক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নিজস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ডিএমপি নিউজ’এ ৩ শতাধিক লাশের পরিচয় শনাক্তে সহায়তা চেয়ে দেয়া বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। এর মধ্যে অনেক বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে ২০১৭ সালে। তবে দীর্ঘ প্রায় আট বছরের বেশি সময়েও এসব লাশের পরিচয় উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। অর্থাৎ নিহতরা এখনও রয়ে গেছেন অজ্ঞাত বা বেওয়ারিশ পরিচয়েই।
রায়ের বাজার কবরস্থানে অজ্ঞাতদের কবরের সারির ছবিটি গত ডিসেম্বর মাসে তোলা: ছবি চ্যানেল 24
সেই হতভাগ্যদের মধ্যে রয়েছেন আনুমানিক ২৬ বছর বয়সী এক যুবক। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার খিলক্ষেত থানাধীন প্রেস ক্লাবের সামনে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। আশপাশের এলাকায় অনেক খোঁজাখুজি করেও মৃতের কোনো স্বজন পায়নি পুলিশ। এ ঘটনায় ১৭ ফেব্রুয়ারি খিলক্ষেত থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি, নং-৩ ) করা হয়। জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) সোহেল আহমেদ চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, স্থানীয়রা জানিয়েছে লাশ উদ্ধারের ২-৩ মাস আগে থেকে খিলক্ষেত এলাকায় ওই যুবককে দেখা গেছে। তাদের ধারণা ওই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন ও ভাসমান ছিলেন। এখনও তার পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
মৃত্যুর পর অজ্ঞাত হয়ে যাওয়া আরেকজন ৪০ বছর বয়সী এক পুরুষ। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি তেজগাঁও এলাকা থেকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পরে ৩ জানুয়ারি রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। এ ঘটনায় ৪ জানুয়ারি তেজগাঁও থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা (যার নম্বর-২) দায়ের করে পুলিশ। সেই মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকতা এসআই মুহাম্মদ শাহজাহানের কাছ থেকে জানা যায়, তেজগাঁওয়ের আলরাজি হাসপাতালের পাশের ফুটওভার ব্রিজ থেকে নিচে পড়ে আহত হয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। ব্রিজের ওপর ঘুমানোর সময় অসাবধানতাবসত নিচে পড়ে যান তিনি। ওই ব্যক্তি রাস্তাঘাটেই থাকতেন। আশপাশের কেউ তার ঠিকানা জানাতে পারেননি। পরে আঞ্জুমান মফিদুলের মাধ্যমে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। তার পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অজ্ঞাত লাশের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, প্রায়ই বিভিন্ন স্থান থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার, কেউবা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এছাড়াও অনেক সময় ভবঘুরে মানুষেরা রোগে-শোকে মারা গিয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকেন। বিভিন্ন থানা এলাকায় এসব লাশ উদ্ধারের তথ্য পেলে আমরা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে লাশের পরিচয় জানার চেষ্টা করি। এছাড়াও আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণসহ বিভিন্ন উপায়ে লাশের পরিচয় জানার চেষ্টা চলানো হয়। কিন্তু অনেক সময়ই পরিচয় জানা সম্ভব হয় না।
এ সময় পুলিশের উদ্ধার করা অজ্ঞাত লাশের মোট সংখ্যার কথা জানাতে পারেননি তিনি। তবে অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের ডিজিটাল ফরেনসিক বিভাগ কাজ (পিবিআই) করে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন: ‘রোহিঙ্গা ফেরানোর চুক্তিতে রাখাইনে মানবিক চ্যানেল দিতে পারে বাংলাদেশ’
পিবিআই জানিয়েছে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমের মাধ্যমে অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করেন তারা। ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৬৯টি অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করেছে তারা। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৮৯৮টি লাশ পুরুষের, বাকি ১ হাজার ৭৭১টি লাশ নারীর। এসব লাশের মধ্যে ১ হাজার ৭৯৯টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে সফল হয়েছে পিবিআই। লাশের পরিচয় শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পরিচয় শনাক্তকৃত লাশের মধ্যে ১ হাজার ৩১৩টি পুরুষের, আর বাকি ৪৮৬টি লাশ নারীর। এখনও ৪ হাজার ৮৭০টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, অর্থাৎ অজ্ঞাতই রয়ে গেছেন তারা।
পিবিআইয়ের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, শুধু অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত নয়, জীবিত ও ভবঘুরে অনেক ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সমাধান কী
অজ্ঞাত লাশের বিষয়ে চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুকের। তার মতে, উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশের নাগরিকদেরও যদি ডিএনএ প্রোফাইলিং করা হতো তাহলে কেউ-ই আর অজ্ঞাত থাকতো না। ডিএনএ প্রোফাইলিং করা থাকলে খুব সহজেই জানা যেত নিহত ব্যক্তি কোন পরিবারের বা তার স্বজন কে। এটা মানুষের পরিচয় শনাক্তের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক একটা পদ্ধতি। এটা থাকলে নিহতের পরিচয় শনাক্ত করে মৃতদেহ স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব হতো।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক: সংগৃহীত ছবি
তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের এই স্বক্ষমতা নেই সেহেতু একটা অজ্ঞাত মৃতদেহ উদ্ধারের পর শুধু থানায় অপমৃত্যুর মামলা করে আর পুলিশের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিলেই হবে না। প্রতিদিন না হোক অন্তত প্রতি মাসে উদ্ধারকৃত অজ্ঞাত মরদেহগুলোর ছবি দিয়ে জাতীয় পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দেয়া উচিত। কারণ আমাদের দেশের সব মানুষ পুলিশের ওয়েব সাইটের কথা জানে না, কিংবা জানলেও অ্যাক্সেস করতে পারে না। যেহেতু আঞ্জুমান মফিদুল অজ্ঞাত লাশ নিয়ে কাজ করে, সেখান থেকেও কিন্তু একটা গণবিজ্ঞপ্তি দিতে পারে তারা। বিজ্ঞপ্তিতে জানাতে পারে এই মাসে এতগুলো এমন এমন লাশ পাওয়া গেছে।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, পরিচয় শনাক্তের অভাবে লাশগুলো শুধু অজ্ঞাত হয়েই থাকে না, ভুক্তভোগী মানুষগুলো বিচারও পায় না। অজ্ঞাত লাশ হয়ে যাওয়া অনেকেই বিভিন্ন অপরাধের শিকার হয়। কিন্তু পরিচয়ের অভাবে তারা বিচারপক্রিয়ায় ঠিকভাবে আসতে পারে না। তাদের হয়ে কথা বলার কেউ থাকে না।