
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই দেশে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায়শই আন্দোলন-অস্থিরতা লেগেই ছিল। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও এসব বিশৃঙ্খলা দমনে মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কোনও কোনও সময় কঠোর হতে দেখা গেছে। সংকট কাটিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ক্রমেই সক্রিয় হয়েছে। এতে এসব অস্থিরতা অনেকটাই কমে এসেছিল। তবে সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি কিছু সহিংসতা, মারামারি ও খুনের মতো ঘটনা ঘটেছে। মধ্যরাতে কিংবা ভোরে কোথাও কোথাও ঘটছে গুপ্ত হামলাও। এসব ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও পুলিশ সদর দফতর বলছে, তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থার কোনও ঘাটতি নেই। সারা দেশে দিনে-রাতে পুলিশের প্রয়োজনীয় টহল ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে। তবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ‘স্থিতিশীলতা’ দেখছেন না অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সম্প্রতি প্রশাসন কঠোর হওয়ার পর কিছু দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আবার তা খারাপ হতে দেখা গেছে। যার কারণ হিসেবে এখনও দুর্বল প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন তারা।
রবিবার (২০ এপ্রিল) ভোর ৪টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় চলন্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় দুই নারী দগ্ধ হয়েছেন। তিন জন মুখোশ পরা ব্যক্তি হঠাৎ পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। একটি বোতল সিএনজির পেছনে আঘাত করলে আগুন ধরে যায়। দগ্ধরা হলেন লাইলী বেগম (৫০) ও তার পুত্রবধূ ঝর্ণা (৩০)। তাদের মধ্যে লাইলী বেগমের শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তবে কারা এ হামলা চালিয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি। তবে নিষিদ্ধঘোষিত কোনও সংগঠন এমন কাজ করতে পারে বলে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা।
বিষয়টি নিয়ে সিএমপির বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. আরিফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বায়েজিদ আতুরার ডিপো এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী এই পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। মোটরসাইকেল কিংবা কারা কেন এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা উদঘাটনের চেষ্টা করছি। এখনও এ ঘটনায় মামলা হয়নি। আহতরা বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন।
তার কয়েক ঘণ্টা আগে শনিবার (১৯ এপ্রিল) রাত পৌনে ১২টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল মোড়ল গলি এলাকা থেকে মতিঝিল থানার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ সরদারকে (৩৫) রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় যুবদলের ওই কর্মী সোমবার (২১ এপ্রিল) সকাল ১০টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) মারা যান।
হাতিরঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রাসেল জানান, ১৯ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরিফকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, দুর্বৃত্তদের ছোড়া গুলি আরিফের মুখের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে কপালের বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ বিষয়ে আজ সোমবার হাতিরঝিল থানায় ১০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের মধ্যকার সংঘর্ষের কারণে নিউমার্কেট ও সায়েন্সল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়
এছাড়া গত রবিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে গাজীপুর টঙ্গী পূর্ব থানার রেল কলোনি বস্তি এলাকায় শত্রুতার জেরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিজন (২৫) নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা জানান, সিজন টঙ্গীর রেলওয়ে কলোনি এলাকার একটি পুরাতন মালামাল বেচাকেনার দোকানে কাজ করতেন। ঘটনার রাত সাড়ে ৮টার দিকে টঙ্গীর রেলওয়ে কলোনি এলাকার একটি দোকানে বসে চা পান করছিলেন সিজন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় দুই যুবক চায়ের দোকানে আসেন। এ সময় তাকে ডেকে বাইরে নিয়ে ধারালো চাপাতি দিয়ে বুকের বাম পাশে কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওই যুবক মারা যান।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপির) টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম জানান, তাদের ধারণা শত্রুতার জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি।
তার আগে শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে দুই নারী শিক্ষার্থীকে দেখে হাসাহাসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বনানীতে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এসময় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ছুরিকাঘাতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী পারভেজ নিহত হন।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিষয়টি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, পারভেজকে হত্যার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জড়িত। তুচ্ছ একটি ঘটনার জেরে একজন মেধাবী ছাত্রকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নয়াপল্টনে বিক্ষোভ মিছিলও করেছে সংগঠনটি। অন্যদিকে রাকিবুলের এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুক পেজে দেওয়া প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলেছে, একজন মৃত ব্যক্তির মরদেহের ওপর দাঁড়িয়ে ছাত্রদলের এমন ঘৃণ্য মিথ্যাচারের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সোবহান নিয়াজ তুষার এবং হৃদয় মিয়াজী পারভেজ হত্যার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নন। এদিকে এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ বলছে, দুই নারী শিক্ষার্থীকে দেখে হাসাহাসির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আমরা পূর্ব শত্রুতা বা রাজনৈতিক বিরোধের মতো কোনও কারণ পাইনি।
এদিকে পুলিশের বাধার মুখেও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগে ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। গত কয়েক দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কে তাদের ঝটিকা মিছিল দেখা গেছে। এসব মিছিল ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেমন নতুন করে চলছে পুলিশের ধরপাকড়, তেমনি বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যরা একে-অপরকে দোষারোপ করছেন। সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এমন পাল্টাপাল্টি বিভাজনে আবার রাজনৈতিক সহিংসতার তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাশাপাশি নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কমে এলেও তা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। সুযোগ পেলে এখনও সড়ক অবরোধ করতে দেখা যাচ্ছে বিক্ষোভকারীদের। সম্প্রতি জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের জন্য বরাদ্দ ৩০ শতাংশ প্রমোশন কোটা বাতিলসহ ছয় দফা দাবিতে টানা কর্মসূচি পালন করেছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এসবের মধ্যেই গত কয়েক দিনে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ বেঁধেছে। সংঘর্ষের জেরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা। রাস্তা অবরোধ করে এসব ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনও ঘাটতি নেই। সারা দেশে দিনে-রাতে পুলিশের প্রয়োজনীয় টহল ব্যবস্থা মোতায়েন রয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ প্রতিদিনই বিভিন্ন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না থাকায় অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। দুর্বল প্রশাসনের কারণে অপরাধীরা মামলা বা গ্রেফতার আমলে নিচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে না। একজন অন্যজনকে প্রতিশোধ নেওয়ার যে প্রবণতা, এটাও বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রান্তিক মানুষের ওপর ক্ষমতাবানদের আক্রমণ, সেটি এখনও দেখা যাচ্ছে।
সোমবার (২১ এপ্রিল) ঢাকা মহানগর পুলিশের মাসিক অপরাধ বিষয়ক সভায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় অবশ্যই মামলা নিতে হবে। কোনও ঘটনা আড়াল করা যাবে না। মামলার রহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অপরাধ যাতে না ঘটে তার জন্য প্রতিরোধমূলক পুলিশি কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, সর্বোচ্চ বিনয়ী থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনও অবস্থাতেই দৃষ্টিকটু ও অপেশাদার আচরণ করা যাবে না। ডিএমপির প্রতিটি থানার ওসিকে মামলা তদন্ত করতে হবে। থানা এলাকার প্রতিটি ভবনের সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গে থানার টহল টিমের সমন্বয় করে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনও অপরাধের তথ্য তাদের কাছে থাকলে তারা যেন পুলিশকে সেই তথ্য প্রদান করে, সেভাবে কাজ করতে হবে।
মঙ্গলবার এক সভায় স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘মব জাস্টিস আর অ্যালাউ (অনুমোদন) করা যাবে না। অনেক হয়েছে। কারও কোনও কিছু বলার থাকলে আইনের আশ্রয় নেবে। অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের আরও বেশি কেয়ারফুল হতে হবে। জামিনের বিষয়টা তো আমাদের হাতে নেই। জজরা বিচার-বিবেচনা করে জামিন দিচ্ছেন।’ এ বিষয়ে আদালতের পিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।