Image description

বড় স্বপ্ন নিয়ে কার্যক্রম শুরুর পর টিকে থাকতে পারছে না বেসরকারি এয়ারলাইনস। একের পর এক দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখাচ্ছে এসব সংস্থা। গত ২৮ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দেড় ডজন দেশি এয়ারলাইনস। নতুন করে নভো এয়ারের ফ্লাইট অপারেশন বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে খাতটির বিপুল বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

বিমান চলাচল খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বেসরকারি এয়ারলাইনসের জন্য আইনকানুন ব্যবসাবান্ধব নয়। অসম প্রতিযোগিতা, আর্থিক সক্ষমতা, জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, উচ্চমাত্রার এরোনটিক্যাল ও নন-এরোনটিক্যাল চার্জ দিয়ে লাভজনক হতে না পেরে কার্যক্রম বন্ধ করেছে কিছু বেসরকারি এয়ারলাইনস। এয়ারলাইনসের উদ্যোক্তারা বলছেন, অতিরিক্ত সারচার্জের কারণে অনেক এয়ারলাইনস দেনা শোধ করতে পারছে না।দেনার চাপে তারা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সময়মতো পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে সারচার্জ দিয়ে পাওনা পরিশোধের নিয়ম অনেক দেশেই আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেবিচকের হার অনেক বেশি।

এছাড়া নীতি সহায়তা, আর্থিক সক্ষমতার অভাব, ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, যুগোপযোগী ব্যবসায়িক কৌশলের অভাবসহ নানা কারণে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বেসরকারী এয়ারলাইন্স। আর বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর সক্ষমতার ঘাটতি কাজে লাগিয়ে দেশের এভিয়েশন শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ দখল করে আছে বিদেশী এয়ারলাইন্স।

জানা যায়, দেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বেসরকারি এয়ারলাইন্স অ্যারো বেঙ্গলকে আকাশপথে চলাচলের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে প্রথম যাত্রী পরিবহন শুরু করলেও ১৯৯৮ সালেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ২০০০ সালে অপারেশন শুরু করে এয়ার বাংলাদেশ। পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।

এ ছাড়া এয়ার পারাবত, জিএমজি এয়ারলাইনস, রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইনস, বেস্ট এয়ার, মিড এশিয়া এয়ারলাইনস, বিসমিল্লাহ এয়ার, টিএইচটি এয়ার সার্ভিসেস, ভয়েজার এয়ারলাইনস বাংলাদেশ, জুম এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ার ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ টিকে থাকতে পারেনি। নতুন করে নভো এয়ার বন্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, বিপুল লোকসানে সংস্থাটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার বদলে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে মালিকেরা যেমন বড় ধরনের লোকসান থেকে বাঁচবেন, তেমনি মালিকানা বদলের পর সংস্থাটি ব্যবসায় টিকে থাকবে। বিক্রির প্রক্রিয়া যদি ব্যর্থ হয়, তবে এটি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি বিকল্প ভাবনায় রয়েছে তাঁদের। এজন্য নভোএয়ার কর্তৃপক্ষ তাদের উড়োজাহাজসহ অন্যান্য সম্পদ বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য সম্ভাব্য দেশি-বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিমান সংস্থাটির উড়োজাহাজগুলো নিরীক্ষা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। 

নভো এয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের বিমান পরিবহনসেবা এখনো চলমান। তবে আমরা আমাদের উড়োজাহাজ ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রির প্রক্রিয়ায় রয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ না করে স্থানীয় বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রির মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তরের। যদি বিক্রি হয় তাহলে নভো এয়ার টিকে থাকবে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এয়ারলাইনস বন্ধ হওয়ার মিছিল যত দীর্ঘ হবে, বাংলাদেশের এভিয়েশন তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেসরকারি বিমান সংস্থার মধ্যে গত ২৮ বছরে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে, যা খুবই দুঃখজনক। এর মধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চষে বেড়ানো জিএমজি এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ও বেস্ট এয়ার উল্লেখযোগ্য। এখন চালু আছে তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলা, নভো এয়ার ও এয়ার অ্যাস্ট্রা। এর মধ্যে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ইউএস-বাংলা স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নবপ্রতিষ্ঠিত এয়ার অ্যাস্ট্রা প্রায় দুই বছরের বেশি সময় পার করলেও সঠিক গন্তব্যে এখনো যেতে পারেনি। আরেকটি এয়ারলাইনস নভো এয়ার নিয়ে নানা গুঞ্জনের ডালপালা ছড়ালেও সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠার দশম বছরে আগাম ঘোষণা ছাড়াই ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। বন্ধ হওয়ার সময় এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানটির কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল ৫৫ কোটি টাকা। তবে বকেয়া সারচার্জ যুক্ত হয়ে পাওনা গিয়ে ঠেকে ৩৫৫ কোটি টাকায়। এয়ারলাইনসটি চালু করতে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এভিয়েশন ও ভ্রমণ বিষয়ক সাময়িকী বাংলাদেশ মনিটর সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ আর আলোর মুখে দেখেনি।

এদিকে ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করা জিএমজি এয়ারলাইনস ২০১২ সালে এসে বন্ধ হয়ে যায়। ফ্লাইট বন্ধের কারণ হিসেবে তারা জেট ফুয়েলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং নতুন ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা নেওয়ার উদ্যোগ-এর কথা জানায়।

অন্যদিকে ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় সব ধরনের ফ্লাইট স্থগিত করা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ছিল ২৮৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আবারও ফ্লাইট পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিল সংস্থাটি। সে সময় বেবিচকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন রিজেন্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আশিস রায় চৗধুরী। দেনার বিষয়ে তাঁরা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সঙ্গে একটি সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন। তবে বেবিচক কোনোভাবেই মোটা অঙ্কের বিলে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাই আর ফিরতে পারেনি চট্টগ্রামভিত্তিক বনেদি ব্যবসায়ী গ্রুপ হাবিব গ্রুপের মালিকানাধীন সংস্থাটি।

বেশ কয়েকটি দেশের সিভিল এভিয়েশনের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশে সারচার্জ ৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ শতাংশ, ওমানে ১০ শতাংশ এবং পাশের দেশ ভারতে প্রতিষ্ঠানভেদে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ, পাকিস্তানে আন্ত ব্যাংকিং এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর ২ শতাংশ। বর্তমানে বেবিচকের বকেয়ার ওপর মাসে ৬ শতাংশ হারে বছরে সারচার্জ দিতে হয় ৭২ শতাংশ।

দেশের এভিয়েশন বিশ্লেষকরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত এ সারচার্জে দেনার চাপে অনেক এয়ারলাইনস দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।

এভিয়েশন বিশ্লেষক এবং ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের (পুনর্গঠিত) সাবেক চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের বিমান চলাচল আইনকানুন বেসরকারি খাতবান্ধব নয়। হানিমুন পিরিয়ড শেষ করে বিগত দিনে তাই অনেক এয়ারলাইনস বন্ধ হয়ে গেছে। তারা সরকারের পলিসি সাপোর্ট পায়নি। ৭২ শতাংশ সারচার্জ হওয়ায় প্রত্যেকটি এয়ারলাইনসের কাছে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা পাওনা আছে সরকারের। সিভিল এভিয়েশন এই টাকা আদায় করতে পারে না। এক পর্যায়ে এয়ারলাইনস তার কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। যত দিন পর্যন্ত এভিয়েশন পলিসি ব্যবসাবান্ধব না হবে তত দিন আমাদের দেশে বেসরকারি এয়ারলাইনস টিকবে না। আর তারা টিকে না থাকতে পারলে বাজার আরো দখলে যাবে বিদেশি এয়ারলাইনসের।

নভো এয়ারের এমডি বলেন, আমাদের দেশে এয়ারলাইন্সের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদ হার বেশি। ঢাকায় উড়োজাহাজের জ্বালানি তেলের দাম অতিরিক্ত। আন্তর্জাতিক পথে যে দামে জেট ফুয়েল কেনা যায়, অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটে একই তেল কিনতে বেশি টাকা বেশি দিতে হয়। সারচার্জ ও তেলের দামের এ বৈষম্যের জন্য ব্যবসা করা কঠিন। তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমে গেছে অথচ বাংলাদেশে কমেনি। এত খরচ দিয়ে দেশি এয়ারলাইনসগুলোর ব্যবসা করে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইমরান আসিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের উচ্চ পরিচালন ব্যয় যাত্রীদের ওপর চাপাতে পারছি না, কারণ তা অনেকের জন্য সাশ্রয়ী হবে না। যাত্রীদের প্রতিযোগিতামূলক ভাড়া দিয়ে ভলিউম বাড়িয়ে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করছি। আমাদের বিনিয়োগকারীরা ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ানোর অন্যান্য লাভজনক খাতে না গিয়ে সেবা মূলক এই শিল্পে এসেছেন। কিন্তু তারা কতোদিন লোকসান গুনবেন।

বেসরকারি বিমান সংস্থা টিকিয়ে রাখতে পাঁচ দফা দাবি : অভ্যন্তরীণ রুটে বেসরকারি এয়ারলাইনগুলো টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এওএবি)। এর মধ্যে আছে সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন, সাশ্রয়ী জ্বালানি তেলের জোগান, উচ্চ কর রহিত করা, যৌক্তিক সারচার্জ নির্ধারণ এবং অসম প্রতিযোগিতার অবসান ঘটানো।

তীব্র প্রতিযোগিতায় বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে টিকে থাকার জন্য সারচার্জ, এয়ারপোর্টের চার্জ, জ্বালানি খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এভিয়েশন খাত বিশ্লেষক উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, এভিয়েশন খাতে দেশিয় এয়ারলাইনসের অংশ খুব কম। সেটা মাত্র ২২ থেকে ২৫ শতাংশ। বাকি ৮৫ শতাংশই বিদেশি এয়ারলাইনসের দখলে। আমাদের উচিত ছিল এটা আরো বাড়ানো।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে এখন বিদ্যমান এয়ারলাইনসগুলো ঠিকমতো চলছে। এর পরও আমাদের দিক থেকে কোনা অসুবিধা থাকলে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো আমাদের সঙ্গে বসতে পারে, তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে। আমরা যেসব সমস্যার কথা জেনেছি, সেগুলো নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। আমরা চাই, দেশের এভিয়েশন খাত আরো বিকশিত হোক, আরো এয়ারলাইনস আসুক, টিকিটের দাম আরো কমুক। আমরা আইকাওয়ের নিয়ম অনুযায়ী এভিয়েশন খাতের নিয়মকানুন যতটা বিনিয়োগবান্ধব করা যায়, সেটা করার চেষ্টা করছি।