Image description
ঢাকা ওয়াসা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ নগরবাসীর । দূষিত পানি ব্যবহার করলে টাইফয়েড, আমাশয়, কলেরাসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ হওয়ার শঙ্কা থাকে-অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম । ক্ষতিকর কোনো জীবাণুর অস্তিত্ব মেলেনি -ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঢাকা ওয়াসা ।

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ, ময়লা এবং ছোট ছোট পোকা পাওয়া যাচ্ছে। পানির রংও পালটে গেছে। প্রায় দুই মাস রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এ অবস্থা চললেও একরকম নির্বিকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তাদের দাবি-ওয়াসার পানি দূষিত নয়। ময়লা, দুর্গন্ধ বা পোকা নিজ নিজ বাসার রিজার্ভারের কারণে হচ্ছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা, উৎকট দুর্গন্ধ এবং পোকা পাওয়ায় অধিকাংশ নগরবাসী ঢাকা ওয়াসার পানি পান করা ছেড়ে দিয়েছেন। বাসাবাড়ির ধোয়ামোছা, রান্না এবং গোসলের কাজ সারছেন। বিশেষ করে মহানগরীর খিলগাঁও, বনশ্রী, কল্যাণপুর, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, বাড্ডা, বাংলামোটর, তেজগাঁও, মালিবাগ, মগবাজার, মুগদা, যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, জুরাইন এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানি পান করতে পারছেন না গ্রাহকরা।

আরও জানা যায়, ঢাকা ওয়াসা এসব অভিযোগের দায় নিচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসা এক বিজ্ঞপ্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করছে, গ্রাহকদের বাসাবাড়িতে ভূগর্ভস্থ ও ছাদে পানি সংরক্ষণের যে ট্যাংক আছে, সেখানেই সমস্যাটি হচ্ছে। এসব পরিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে; তবে অনেক গ্রাহক ওয়াসার কথামতো পানির ট্যাংক পরিষ্কার করেও কোনো ফল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।

ঢাকা ওয়াসার এক প্রকৌশলী জানান, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর কল্যাণপুর, মগবাজার, মধুবাগ, আরকে মিশন রোড থেকে পানির অর্ধশত অভিযোগ পাওয়া যায়। প্রতিটি জায়গায় ওয়াসার লোক পাঠিয়ে চেক করা হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ লাইনের পানিতে কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া পরিশোধিত পানিতে ক্লোরিন মিক্স করে সরবরাহ হয়। ফলে সেখানে কোনো পোকা থাকলেও তা মারা যাওয়ার কথা।

তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলোর পানি নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। কোথাও পানিতে সমস্যা পাওয়া যায়নি। ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন ২৮৫ থেকে ২৯০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি স্থান থেকে অভিযোগ মিলেছে-এসবের অধিকাংশই বাড়িতে তাদের নিজস্ব ওয়াটার রিজার্ভার পরিষ্কার করা হয় না।

নাগরিক অধিকারকর্মী এবং পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা জুরাইন এলাকায় নতুন পাইপলাইন করেছে। কিন্তু তাতেও পানির সমস্যা সমাধান হয়নি। গ্রীষ্মের সময় মানুষের পানির চাহিদা বেশি। অথচ দিনের বেশির ভাগ সময়ই পানি পাওয়া যায় না। দিনে ২ ঘণ্টার মতো লাইনে পানি পাওয়া যায়। সেই পানিও পানের অযোগ্য। পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ, পয়ঃবর্জ্য এবং পোকামাকড়ও পাওয়া যাচ্ছে। এসব তথ্য কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও নির্বিকার রয়েছেন তারা।

যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা এবং গণমাধ্যমকর্মী মো. মাহবুব হোসেন স্বপন যুগান্তরকে বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকার ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি খুবই নিম্নমানের। পানিতে উৎকট দুর্গন্ধ, ময়লা ও পোকামাকড় পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য বাইরে থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন তারা। তবে গোসল এবং অন্যান্য প্রয়োজনে ঢাকা ওয়াসার পানি ব্যবহার করলেও শরীরে চুলকানিসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার কার্যকর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।

এবি পার্টির উদ্বেগ : ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার পানিতে কেঁচো বা এই ধরনের পোকামাকড় এবং ভয়াবহ ই-কোলাই ভাইরাস পাওয়ার পরও ওয়াসা নির্বিকার বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। রোববার ‘ওয়াসার দূষিত পানি : ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নগরবাসী’ বিষয়ে এবি পার্টি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমন অভিযোগ করেন। তিনি জানান, প্রতিবছর পানি নিয়ে একই পরিস্থিতি বিরাজ করলেও এর কোনো সমাধান নেই। বছরের পর বছর কোনো সরকারই বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তা তৈরি করতে পারেনি। ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যেসব দুর্নীতিবাজ কেঁচো বা পোকামাকড় বসে আছে, তাদের অপসারণ ব্যতীত নগরবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব নয়।

সংবাদ সম্মেলনে দূষিত পানির ভোগান্তি ও এর সমাধান বিষয়ে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন এবি পার্টির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নাসরীন সুলতানা মিলি। তিনি বলেছেন, প্রতিবছরই গ্রীষ্মের শেষ এবং বর্ষার শুরুতেই ওয়াসার পানি হয়ে ওঠে নোংরা পোকামাকড়ের প্রজননক্ষেত্র। দূষণের পরিমাণ এতটাই বাড়ে যে এটার কারণে রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো সমাধান চিন্তা করা হয়নি। ২০১৯ সালে একজন আইনজীবীর রিটে হাইকোর্ট ডিভিশন ৭ দিনের মধ্যে জানতে চেয়েছিলেন ওয়াসার পানির স্যাম্পলে পয়ঃবর্জ্য এবং অ্যামোনিয়ার উপস্থিতি কেন পাওয়া গেছে? যার উত্তর প্রায় ৭ বছরেও পাওয়া যায়নি, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।

ঢাকা শহরে শীতের পরেই শুরু হয় অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কম্পিটিশন উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, প্রায়ই দেখা যায় স্যুয়ারেজ এবং পানির লাইন ফুটো হয়ে এক হয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও উন্নয়নের ডামাডোল আর স্মার্ট বাংলাদেশের ভিড়ে আমরা একটি বিশুদ্ধ সুপেয় পানি সাপ্লাই চেইন স্থাপন করতে পারিনি, যা আমাদের ব্যর্থতা। সেখানে বলা হয়, ওয়াসার আগের এমডি তাকসিম এ খানের মতো বর্তমান এমডিরও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে কোনো দৃশ্যমান কাজ করতে দেখিনি। হাজার হাজার নাগরিকের যেখানে ই-কোলাই জীবাণু এবং পোকামাকড় দিয়ে পূর্ণ পানি খেয়ে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়, তখন ঢাকা ওয়াসার এমডির পক্ষ থেকে সমাধান তো দূরের কথা, কোনো বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞ অভিমত : বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং খ্যাতিমান ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, পানি দূষিত হলে সেসব পানি ব্যবহারে টাইফয়েট, আমাশয়, কলেরাসহ পানিবাহিত নানাবিধ রোগব্যাধি হতে পারে। এজন্য ঢাকা ওয়াসার পাশাপাশি বাড়ির মালিকদেরও সচেতন হবে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, যেসব এলাকার পানিতে ময়লা, দুর্গন্ধ এবং পোকামাকড় পাওয়ার খবর মিলেছে, সেসব এলাকা থেকে পানি নিয়ে পরীক্ষায় খারাপ কিছু পাওয়া যায়নি। এজন্য আমরা ভবন মালিকদের বাসাবাড়ির নিজস্ব রিজার্ভার পরিষ্কার করার পরামর্শ দিচ্ছি। এরপরও ঢাকা ওয়াসার কোথাও কোনো ত্রুটি রয়েছে কি না, সে বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা সতর্ক রয়েছেন।