
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে এখনো অনড় বিএনপি। দলটি এই দাবির পক্ষে যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পাচ্ছে। এখন ডান ও বামপন্থী আরো গুরুত্বপূর্ণ দলের সমর্থন নিয়ে বিএনপি বড় প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল একমত হলে দাবি আদায় সহজ হবে।
গত ৬ এপ্রিল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। ওই বৈঠকে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের যে দাবি তুলেছে, তাতে হেফাজত একমত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনের শরিকদের বাইরে অন্য দলগুলোর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে।
দলের নেতারা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জোরালো করছে বিএনপি এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গঠনের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দ্রুত আরো কর্মসূচি পালন করা হবে।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ঈদের আগে নির্বাচনের দাবিতে তাঁরা এককভাবে কর্মসূচি পালন করেছেন। চলতি মাসে দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচি শুরু হতে পারে। এই কর্মসূচিকে যুগপৎ আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনাও করা হচ্ছে। এতে সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের অনেকে কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে মত দিয়েছেন। নির্বাচন বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না পেলে দ্রুত কর্মসূচির দিকে এগোবেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদ নির্বাচন এবং এই লক্ষ্যে দ্রুত রোডম্যাপ দেওয়ার দাবিসহ কয়েকটি বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ করার কথা। তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাবচন ও দ্রুত রোডম্যাপের বিষয়ে সরকারের অবস্থান তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চাইবেন। প্রত্যাশিত ঘোষণা না এলে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হবে।
ডান ও বামপন্থীদের প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা : বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের এখন শুধু দূরত্বই তৈরি হয়নি, দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে এক ধরনের বিরোধও রয়েছে। রাজনীতির মাঠে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। এতে বিএনপি এখন জামায়াতকে পাশ কাটিয়ে ডান ও বামপন্থীদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে। জামায়াতবিরোধী ইসলামপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের বৈঠকও হয়েছে। বামপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তাদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
নতুন এই প্ল্যাটফর্ম তৈরির আপাতত লক্ষ্য হচ্ছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করা এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়ে একসুরে কথা বলা।
দলের নেতারা মনে করেন, সারা দেশে বিএনপির বিরুদ্ধে যে প্রচারণা, এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সেই জবাব এলে মানুষের কাছে তা অধিক গ্রহণযোগ্য হবে। বিএনপি কয়েকটি দলের সমন্বিত এই প্রচারণার জবাব দেওয়ার কৌশল খুঁজছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী জোট বা আসন সমঝোতাও হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের জোট হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে তাঁরা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন। সেই দলগুলোর সঙ্গে এখনো তাঁদের মতের মিল আছে। এই দলগুলোসহ অন্য ডান ও বামপন্থী দলের সঙ্গে আন্দোলন বা নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট হতেই পারে।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অস্পষ্ট। আমরা স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি।’
এরপর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহউদ্দিন আহমদসহ অনেক নেতাই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে তাঁদের কঠোর অবস্থান তুলে ধরেন।
একই সময় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না।
সম্প্রতি ফেসবুকে এনসিপির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমের মন্তব্যে (উত্তরাঞ্চল) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার মত প্রকাশ করা হয়েছে।
বিএনপি জোটের নেতারা ধারণা করছেন, পরিকল্পিতভাবে এই বক্তব্য সামনে আনা হয়েছে। ঘুরেফিরে বিএনপিকে ঠেকানো এবং নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রক্রিয়ার অংশ এটি।
রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, সরকারের মধ্যে থাকা কয়েকজন উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপ দিতে চান।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, মানুষ এই সরকারকে দুর্বল ও অকার্যকর মনে করায় নৈরাজ্যের বিস্তার ঘটছে। গণ-অভ্যুত্থানের আট মাসেও মানুষের জীবনে স্বস্তি আসেনি। তাই এ সরকারের সময় বাড়ানোর যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেটি না করাই উত্তম। তিনি বলেন, নির্বাচন যত ঝুলে যাবে, সরকারকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা তত বাড়তে থাকবে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার যে মত তৈরি হয়েছে, সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বাস্তবে রূপ দেওয়া।
ভোটের দাবিতে কর্মসূচি বাড়াবে বিএনপি : দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের সময় নিয়ে সরকার বা অন্য কোনো পক্ষ বাড়াবাড়িতে গেলে বিএনপি মাঠের কর্মসূচি জোরদার করবে। একই সঙ্গে সংস্কারের নাম করে ভোটের তারিখ পেছানোর চেষ্টাও মানবে না দলটি। বিএনপি ছাড়াও তাদের জোট শরিক, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ধর্মভিত্তিক কিছু দলও দ্রুত নির্বাচন চায়।
দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বলেন, কর্মসূচি জোরদার করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা চলছে। ঈদের আগে জেলা পর্যায়ে সমাবেশ হলেও এবার বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ করার কথা ভাবা হচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল নেতারা জানান, সম্প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি উঠেছে, সেটাকে একেবারেই গুরুত্ব দেবে না বিএনপি। বরং দলটি জাতীয় নির্বাচনকে মুখ্য করেই পরবর্তী সাংগঠনিক কর্মসূচি তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৭ বছর ধরে আমরা আন্দোলন করেছি। আমাদের নেতাকর্মীরা গুম-খুন ও হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সুতরাং নির্বাচন দিতে গড়িমসি করা হলে মাঠের কর্মসূচি জোরদার করতেই হবে।’
বিএনপির মিত্র দল বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ না দিলে অতীতের মতো সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে যুগপত্ভাবে আন্দোলন করা হবে।