
রাজধানী ঢাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি স্থাপনা। এই শহরে বছরে এক লাখের বেশি স্থাপনা গড়ে উঠছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০০৬ সালের পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে রাজধানীতে ১০ লাখ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সর্বশেষ ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে ২০১৬ সালে রাজধানীতে স্থাপনা দেখানো হয়েছে ২১ লাখ ইউনিট। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ঢাকা ইতোমধ্যে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আবার প্রতি বছরে যে হারে নতুন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে তাতে খুব শিগগিরই ঢাকা একটি মৃত শহরে (ডেড সিটি) পরিণত হবে। ২০১৬ সালের পর থেকে প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে এক লাখ ২০ হাজার স্থাপনা গড়ে উঠে থাকতে পারে, যদিও স্থাপনা নিয়ে ২০১৬ সালের পর থেকে আর কোনো তথ্য বিবিএসের কাছে নেই।
এতো বেশি স্থাপনা তৈরি হওয়ার বিপরীতে চলাচলের জন্য ঢাকায় রাস্তার পরিমাণ একেবারেই কম। অর্থাৎ মানুষ বাসবাস করার জন্য অথবা বাণিজ্যিক কাজে স্থাপনা তৈরি করলেও চলাচল করতে রাস্তার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা রাখে না।
সর্বশেষ ড্যাপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাড়ি-ঘর রয়েছে এক হাজার পাঁচটি। তা ছাড়া যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে অথবা সামর্থ্যরে অভাবে ঢাকায় হাইরাইজ ভবনের সংখ্যা একেবারেই কম। এই শহরে ৭৬ শতাংশের বেশি স্থাপনা কাঁচা অথবা আধা পাকা। অর্থাৎ ২৪ শতাংশের কম স্থাপনাই পাকা। আবার ৮৪ শতাংশ স্থাপনাই একতলা বিশিষ্ট। এক থেকে তিন তলা বিশিষ্ট স্থাপনা ৯৩ শতাংশ। ঘনত্ব বেশি বলে ঢাকার স্থাপনাগুলো গায়ে গায়ে লাগানো। ফলে ২০০০ সালের পর থেকে এই শহরের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।
রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিকল্পনা নিয়ে ও পরিবেশ রক্ষা করে সুউচ্চ ভবন করতে পারলে এত স্থাপনার প্রয়োজন ছিল না। এজন্য সরকারকে এগিয়ে আসার সাথে সাথে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষা করে হাইরাইজ ভবন করতে পারলে এবং কাঁচা, আধা পাকা বাড়ির মালিককে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দিয়ে সুউচ্চ ভবনে তুলে দিয়ে বাকি স্থানগুলো ফাঁকা করে দেয়া যায়। সেসব স্থানগুলো ফাঁকা রাখতে পারলে পরিবেশ যেমন সুরক্ষা হবে আবার কৃষি কাজে ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের তথ্য থেকে জানা যায়, সমগ্র রাজউক এলাকায় আবাসিক ও আবাসিক-মিশ্র ভবনের মধ্যে ৬ তলার অধিক উচ্চতার মাত্র ০.৬৭ শতাংশ ভবন রয়েছে। রাজউক এলাকায় আবাসিক ও আবাসিক-মিশ্র ভবনের মধ্যে ৮ তলার অধিক উচ্চতার ভবন রয়েছে মাত্র ০.১৬ শতাংশ। অপর দিকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর এবং দক্ষিণ) প্রায় ৫৪.৪৬ শতাংশ স্থাপনাই কাঁচা এবং আধাপাকা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) প্রায় ৬০.৪১ স্থাপনা একতলা বিশিষ্ট।
ঢাকার স্থাপনাগুলোর ঘনত্বের দিক থেকে পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রতি একরে ১৫০ জন মানুষ বাস করতে পারলে ভালো। ঢাকা শহরের ধারণক্ষমতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, প্রতি একরে ১৫০ জন বসবাসকে স্ট্যান্ডার্ড ধরলে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯০ ভাগ ওয়ার্ড ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে। প্রতি একরে ২০০ জন হিসেবে, ৮১ ভাগ ওয়ার্ড ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং প্রতি একরে ৪০০ জন হিসেবে, ৬৩ ভাগ ওয়ার্ড ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে। ড্যাপে ২০১৮ সালের তথ্য উল্লেখ করে বলেছে, লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বাস করে যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ (১ম)। অন্য দিকে ঢাকার চকবাজারে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় এক লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বাস করে যা বিশ্বের মধ্যে তৃতীয়। কোতোয়ালি থানাধীন প্রতি বর্গ কলোমিটার এলাকায় এক লাখ এক হাজার ৬৯৩ জন মানুষ বাস করে যা বিশ্বের মধ্যে ১০ম।
পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা ইতোমধ্যে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারলে এবং ঢাকার বাইরে সরকারি কিছু দফতর নিয়ে যেতে পারলে এখানে মানুষের আগমন কমবে। অন্য দিকে শিল্প-কারখানাগুলো রাজধানী থেকে সরিয়ে অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাহলে এই শহরে মানুষের আগমন কিছুটা হলেও কমিয়ে রাখা যাবে। তা ছাড়া সরকারের সচিবালয় বর্তমান যেখানে আছে সেখান থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিতে পারলেও ঢাকার ওপর চাপ কিছুটা কমবে। এটা নির্ভর করবে সরকারের সদিচ্ছার ওপর, ঢাকা যেন এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে না পড়ে সেজন্য এখনই পরিকল্পনা করে কিছু কাজ করতে হবে।