
ভোট নেই। কথা বলার অধিকার নেই। প্রতিবাদ করার ভাষা নেই। সবকিছু একতরফা। সবকিছুতে মিথ্যাচার। সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের চেহারাটা এভাবেই সবার কাছে উন্মোচিত হতে থাকে। ফ্যাসিবাদের নগ্ন রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করে। রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে শেখ হাসিনার শোষণ-জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও তার বিভিন্ন বাহিনী ও দলীয় গুন্ডাদের দমন-পীড়নের মাধ্যমে তাদের কণ্ঠ রোধ করে দেওয়া হয়। সব অন্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে এক সময়। জুলাই আন্দোলনে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে জোর করে ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা করেও না পেরে শেষতক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান ঘটে। গণ-অভ্যুত্থান পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও ছাত্র-জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার উপদেষ্টা পর্ষদ।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের পতনের পর হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এক বার্তায় বলেছিলেন, এখন আর তার মায়ের কোনো দায়িত্ব নেই। আওয়ামী লীগের লোকজনের কি হবে, কি হবে না সেটা তাদের বিষয়। এমনভাবে পরাজয়ের পর দলটির কোনো নেতা তো দূরের কথা, একজন সমর্থকও ভাবেননি পতনের ৭ মাসের মাথায় এসে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের নিয়ে কেউ আলোচনা করবে। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে সেটা। কেউ কেউ গর্ত থেকে মুখ উঁচিয়ে শব্দ করার চেষ্টা করছেন। অপরদিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলের কেউ কেউ কায়দা-কানুন করে কীভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা যায় তা নিয়ে একটু-আধটু বলার চেষ্টা করছেন। এতে করে রাজনৈতিকভাবে ফেরার সুযোগ বা রাস্তা খুঁজতে শুরু করে আওয়ামী লীগ। কেউ কেউ সংস্কারের মাধ্যমে হাসিনামুক্ত আওয়ামী লীগের বিষয়ে পরামর্শ দেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে প্রথমে ছাত্রদের পক্ষ থেকে বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির পক্ষ থেকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেওয়া হয়-আওয়ামী লীগের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় তোলপাড়। যারা নরম সুরে ‘মিনমিন’ করে কায়দা করে আওয়ামী লীগের বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন, তারা একটা ধাক্কা খেলেন। গত দুদিনে রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে নজর দিলে এটা এখন স্পষ্ট যে, দেশের মানুষ বিনা বিচারে আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দিতে নারাজ।
এদিকে, আওয়ামী লীগের কাছে সাড়ে ১৫ বছরে পিষ্ট রাজনৈতিক দল, মত এবং জুলাইয়ে অকাতরে জীবন দিতে শেখা ছাত্র-জনতার মধ্যে দূরত্বের কারণে ফ্যাসিস্ট হাসিনা আবারও দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারেন-এমন আভাস-ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। যা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির জন্য মোটেও সুখকর নয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অপরদিকে, রাজনৈতিক দলের নেতারাও ফের চোখ-কান খুলে কথা বলছেন। তারা নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো ভেদাভেদ ভুলে বিশেষ করে নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে বিবাদে না জড়িয়ে ৫ আগস্টের আগের সেই দিনগুলোর মতো এক কাতারে আসতে চান। তবে এরজন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার সম্মতিতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঐক্য গঠনে এবারও দায়িত্ব নিতে হবে-বলছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিশ্লেষকরাও বলছেন, দলীয় নীতি-আদর্শ এবং দর্শনে মতভিন্নতা সত্ত্বেও সব পক্ষই শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। দিনশেষে তারা সফলও হয়েছে। এখন রাষ্ট্র মেরামত ও গণতন্ত্র উত্তরণেও তাদের ঐক্যবদ্ধভাবেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদী শক্তি আওয়ামী লীগের বিচার, দলটিকে নিষিদ্ধ করা এবং তাদের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়েও ঐক্য প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে খেসারত দিতে হবে আন্দোলনে জয়ী শক্তিগুলোকেই। ঐক্যের বিষয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। তিনি সেখানে বলেন, ছাত্র-জনতার জুলাই ঐক্য পারবে আওয়ামী লীগের ফিরিয়ে আসা ঠেকিয়ে দিতে। অভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা ও পরিকল্পনা আগেই দিয়েছি। সেখানে গণতন্ত্রের পক্ষের কথা স্পষ্ট আছে। গণতন্ত্রের পক্ষের কথাই হচ্ছে ফ্যাসিবাদবিরোধী।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার সবাইকে এক কাতারে আসার বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ভিত্তিতে আমরা জাতিকে সব সময় জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি। রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন মতের নানা লোক নানা কথা বলে। এটাকে আমরা কাদা ছোড়াছুড়ি বলে মনে করি না। তবে জাতীয় ইস্যুতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রাজনীতির পথ-পন্থা, সংস্কার প্রস্তাব এসব নিয়ে দলগুলোর ভেতরে ভিন্নমত থাকতেই পারে। ভিন্নমত আছে বলেই অনেক দল।
ঈদের পর ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক জায়গায় আসার পরিকল্পনা আছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাব, কথা বলব। সবার সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। জাতিকে এই সংকট থেকে বাঁচানোর জন্য সব দলের একটা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জামায়াত অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য করা প্রয়োজন। কিন্তু আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নিজে আবার রাজনীতির মাঠে প্রবেশের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আমরা (রাজনৈতিক দলগুলো) আওয়ামী লীগ নিয়ে কথাবার্তা বলে তাদের মাথায় এই বিষয়টি ঢুকিয়ে দিচ্ছি। এজন্যই ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য লাগবে। একটা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে তার ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, এর জন্য প্রয়োজনে প্রধান উপদেষ্টাকে নতুন করে ভূমিকা রাখতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী একটা রাজনৈতিক ঐক্য অনেকদিন আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতসহ অপরাপর রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। সেই ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য থাকার কারণে শেখ হাসিনার সময়ে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম চলেছে। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ছাত্রদের সামনে রেখে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যেমন মুক্তিযুদ্ধের পরে জাতিকে একটা বিভক্তির দিকে নিয়ে গিয়েছিল এবং বিভক্তির রাজনীতি করেছিল, ঠিক তেমনি ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে কিছু ছাত্রনেতা আছে যারা বিভাজনের রাজনীতি দাঁড় করাতে চাচ্ছে। সচেতন মহল এ বিষয়ে সতর্ক আছে।
নুরুল হক নুর আরও বলেন, রাজনীতিতে অনেকের বয়স কম, অভিজ্ঞতা কম। ফলে তারা বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে একটা ধোঁয়াশা তৈরি করছে। কিংবা এমন কিছু কাজ করছে, যেটা ফ্যাসিবাদকে উসকে দেওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা এ বিষয়ে সচেতন আছেন। হয়তো সাময়িক সময়ে কিছু বিষয়ে মত-দ্বিমত তৈরি হতে পারে, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রশ্নে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর একটা শক্ত অবস্থান থাকবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নেও আশা করি দৃশ্যমান অবস্থান রাজনৈতিক দলগুলোর জায়গা থেকে দেখতে পাব। তনি বলেন, বর্তমান ইস্যুতে সরকারের হাতে সুযোগ আছে জাতীয় সংলাপ ডাকার। জাতীয় ঐক্যকে সুসংহত করার উদ্যোগ নেওয়ার। সরকার উদ্যোগ নিলে রাজনৈতিক দলগুলো সাড়া দেবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্টের পর ধীরে ধীরে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে এটা সত্য। এর বড় দায় অন্তর্বর্তী সরকারের। কারণ এই সরকার হলো সবার ঐক্যের ফসল। আমরা প্রথম দিন থেকে তাকে (প্রধান উপদেষ্টা) পরামর্শ দিয়েছিলাম রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত সমন্বয়ের জন্য একটা টিম করতে। তিনি গুরুত্ব দেননি। এখন আমরা দেখছি সরকার, বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এই তিন পক্ষের মধ্যে কিছু বিষয়ে দ্বিমত এবং নানা বিতর্ক হচ্ছে। কখনো কখনো তা বিরোধ পর্যায়েও গড়াচ্ছে। সরকার চাইলেই এই বিষয়গুলো সমন্বয়ের জন্য একটা ব্যবস্থা নিতে পারে। আমার মনে হয়, ৫ আগস্টের অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের ফলে সবার মধ্যেই একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনে বড় বিপদ বা জটিলতা তৈরি হতে পারে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় এই মুহুর্তে প্রয়োজন সংলাপ। আমরা যদি যার যার জায়গায় জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে পারি, তাহলে মতবিরোধ তা দূর করা সম্ভব। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিক হতে হবে। সরকারকেও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ভেতরে সম্প্রতি যে অনৈক্য দেখা দিচ্ছে, এটা কিভাবে দূর করা সম্ভব-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন, নির্বাচনকে সামনে রেখে নানা ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, এটা আমরা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে জনগণের কাছে যেতে হয়। কাজেই সব রাজনৈতিক দলগুলো যদি একটা মতানৈক্যে আসে এবং ছাত্রদের সঙ্গে একটা সম্পর্কে যায়, তাহলে সংকট উত্তরণ ঘটবে। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য তৈরিতে অবশ্যই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার তো জনগণের। ফ্যাসিস্ট তো জনগণ চায় না। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বও অনেক বেশি।