
দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প কক্সবাজারের মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আমদানি করা কয়লার একটি চালানে বিপুল পরিমাণ কাদামাটি পাওয়া গেছে। এরপর কয়লার চালানটি ফিরিয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনাকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানি (সিপিজিসিবিএল)।
সিপিজিসিবিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, টেন্ডারের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আদিত্য বিরলা গ্লোবাল ট্রেডিং এই চালান পাঠায়।
কিন্তু চালানটির কয়লায় বিপুল পরিমাণ কাদামাটি ছিল। ফলে এই কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহারোপযোগী নয়। ৬৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে জাহাজটি বন্দরে এলে প্রায় ২০ হাজার টন কয়লা খালাস করা হয়। কিন্তু এসব কয়লা খালাস করতে গিয়ে দেখা যায়, কয়লার সঙ্গে কালো রঙের কাদামাটি। স্বাভাবিকভাবে কয়লা কালো ও শুকনা থাকে। কিন্তু আমদানি করা কয়লার সঙ্গে কাদামাটির মিশ্রণ আর ভেজা। এসব কাদামাটি তাই খালাস না করে ফেরত পাঠিয়েছে সরকারি সংস্থাটি।
সিপিজিসিবিএল সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৬৩ হাজার টন কয়লা আমদানি করা হয়। গত ১৭ মার্চ ‘এমভি ওরিয়েন্ট অর্কিড’ নামের সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী একটি জাহাজ মাতারবাড়ী বন্দরের চ্যানেলে প্রবেশ করে। গত ২১ মার্চ জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা। খালাস করার সময় দেখা যায়, কয়লায় প্রচুর পরিমাণ কাদামাটি মিশ্রিত রয়েছে। অথচ চুক্তি ছিল, ইন্দোনেশিয়া থেকে উচ্চমানের কয়লা সরবরাহ করবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। ফলে কয়লা খালাসের সময় বারবার আনলোডিং কনভেয়ার বেল্টে আটকে যাচ্ছিল। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জাহাজ থেকে কয়লা খালাস বন্ধ করে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, সরবরাহকারী কাদামাটিমিশ্রিত নিম্নমানের কয়লা দেওয়ায় তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লার বদলে কাদামাটি এসেছে। এখন জাহাজটি বহির্নোঙরে রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আবেদন করেছে, জাহাজটিতে কয়লার চেয়ে কাদামাটি বেশি। বিষয়টি কাস্টমস পরীক্ষা করে দেখবে। এ ছাড়া এ নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সে অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাদামাটিমিশ্রিত কয়লার জাহাজটি এরই মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এটা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অভিযোগ উঠেছে, জাহাজটির ব্যবহার অনুপযোগী কয়লা যেকোনোভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে গছিয়ে দিতে ব্যাপক তদবির চালানো হচ্ছে। এ কারণে জাহাজটি সাগরের দূরবর্তী স্থানে না পাঠিয়ে কাছাকাছি রাখা হয়েছে। বন্দর ও কয়লাবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আমদানি করা প্রতি টন কয়লার দাম পড়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। ভারতীয় কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইন্দোনেশিয়া থেকে ভালো মানের কয়লা সরবরাহ করার কথা থাকলেও কাদামাটি মেশানো এবং ভেজা কয়লা সরবরাহ করে আসছিল। কয়লাবাহী জাহাজটি পরিচালনায় রয়েছে মেঘনা গ্রুপ অব কম্পানি।
এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (শিপিং অপারেশন) উজ্জ্বল কান্তি বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়লার বদলে কাদামাটি এসেছে বিষয়টি সত্য নয়। একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে কাদামাটি এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা এ বিষয়ে পরীক্ষা করেনি। কায়িক পরীক্ষার পর কয়লা আসছে নাকি মাটি আসছে, সেটা নিশ্চিত হলেই বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা করব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি জাহাজ থেকে কয়লা খালাস না করে সেটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পাঠানো হয়েছে। আরো একটি জাহাজে কয়লা রয়েছে। সেটি মাতারবাড়ী বন্দরের চ্যানেলে প্রবেশ করবে।’
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক বলেন, ‘আমদানি করা ৬৩ হাজার টন কয়লার মধ্যে ২২ হাজার ৩৫০ টন কয়লা আনলোড করা হয়। কাদামাটি দেখে এক পর্যায়ে খালাস বন্ধ করে দিয়ে ৪০ হাজার ৬৫০ টন কয়লাসহ জাহাজটি বহির্নোঙরে পাঠানো হয়েছে। আমরা চালানটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অফিশিয়ালি চিঠি দিয়ে সেটা জানানো হয়েছে।’
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘টেন্ডারের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা সংগ্রহের দায়িত্ব পাওয়া ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এই চালান পাঠিয়েছে। কিন্তু চালানটির কয়লায় বিপুল পরিমাণ কাদামাটি পাওয়া গেছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহারোপযোগী নয়। আমরা কয়লাগুলো গ্রহণ না করে ফেরত পাঠিয়েছি।’
আরেকটি জাহাজের কয়লায়ও ভেজার লক্ষণ
এদিকে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে গতকাল রবিবার আরো একটি জাহাজ কয়লা নিয়ে ভিড়েছে। ওই জাহাজ থেকে কয়লা আনলোড করতে গিয়েও দেখা গেছে, আগের জাহাজটির মতোই ভেজার লক্ষণ। তবে বহির্নোঙরে পাঠানো আগের জাহাজের কয়লার মতো বিপুল পরিমাণ কাদামাটি মেশানো কি না তা বলা মুশকিল। কারণ ৭০ হাজার টন কয়লা মাত্র খালাস শুরু করা হয়েছে। গতকাল রবিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত নতুন ভেড়া জাহাজটি থেকে কয়লা খালাস অব্যাহত ছিল। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে দুটি জাহাজে করে আনা কাদামাটি মেশানো ও ভেজা কয়লা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় চলছে।
তবে গতকাল ভেড়ানো জাহাজের কয়লা ভেজা নয় বলে দাবি করেছেন মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘নতুন করে ভেড়ানো জাহাজ থেকে কয়লা খালাসের কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। পুরোপুরি খালাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৭ মার্চ আসা জাহাজটির কয়লা কোনোভাবেই নেওয়া হবে না বলে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট সার্বক্ষণিক চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতি মাসে যেখানে চারটি জাহাজ ভর্তি কয়লা আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তখনই ঘটতে শুরু করেছে এমন সব ‘আজব ঘটনা’। এমনিতেই শীত বিদায় নেওয়ার পর দেশব্যাপী তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়তে শুরু করেছে। চাহিদা পূরণে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ নিরবচ্ছিন্নভাবে দুটি ইউনিট চালুর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন রীতিমতো বিপাকে পড়েছে।
মহেশখালীতে ১২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুই ইউনিট থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। জাপানের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের ২৯ জুলাই। এরপর দ্বিতীয় ইউনিটের আরো ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বরে। শুরুর দিকে দুটি ইউনিটেই পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। এরপর ২০২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দুই ইউনিটের ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কয়লা লাগে দৈনিক ১০ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টন। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানের সুমিতোমো করপোরেশনের মাধ্যমে আমদানি করা হয় অন্তত ২২ লাখ পাঁচ হাজার টন কয়লা। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।