
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারসহ এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমে সরকারের উপদেষ্টাদের অংশগ্রহণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের চিন্তা করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালায় ওই বিধান যুক্ত হতে যাচ্ছে। এ-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ যুক্ত করে আচরণ বিধিমালা সংশোধনীর খসড়া তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়। ওই খসড়া সংশোধনীর ওপর দুদিন বৈঠক করেছে ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি. ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি এবং উপকারভোগী পর্যায়ে আলোচনাবিষয়ক কমিটি।’ ওই কমিটির একাধিক সদস্য জানান, খসড়ায় ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’র সংজ্ঞায় ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যসহ সমপর্যায়ের ব্যক্তি’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা যাতে কারও পক্ষে নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশ না নেন, সেজন্য আরও কী কী বিধান যুক্ত করা দরকার সেই আলোচনা চলছে। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার গতকাল যুগান্তরকে বলেন, উপদেষ্টারা কোনো প্রার্থীর পক্ষে যেন প্রচারণা না করেন, সেজন্য কি বিধি যুক্ত করা যায় আমরা তা নিয়ে চিন্তা করছি। এটি এখনো ফাইনাল (চূড়ান্ত) করিনি। তিনি বলেন, আচরণ বিধিমালা সংশোধন নিয়ে কাজ চলছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)। আইনটি সংশোধনে সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এছাড়া দলীয় সরকারের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে ওই আইন সংশোধনের প্রয়োজন হবে। ওই আইন সংশোধনের আগেই আচরণ বিধিমালার সংশোধনী নিয়ে কাজ করছে ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি এবং উপকারভোগী পর্যায়ে আলোচনা বিষয়ক কমিটি।’ ওই কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। নির্বাচন ভবনে তার সভাপতিত্বে গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল রোববার এই খসড়া আচরণ বিধিমালার ওপর বৈঠক হয়। এটি চূড়ান্ত করতে আরও বৈঠকের প্রয়োজন হবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, খসড়া আচরণ বিধিমালায় আরও কিছু সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। কোনো প্রার্থী আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করলে তার প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা আরপিওতে ইসিকে দেওয়া হয়েছে। সেটা খসড়া আচরণবিধিতে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচনি প্রচারের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারে মিছিল করার সুযোগ ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তবে বন্ধ করা হচ্ছে জনসভা এবং বিলবোর্ড। এছাড়া পরিবেশের মান রক্ষায় নির্বাচনি পোস্টারে পলিথিন এবং প্লাস্টিক ব্যানার (পিভিসি) ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দের মান ৬০ ডেসিবেল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের ২২ জন উপদেষ্টা রয়েছেন। এছাড়া উপদেষ্টার মর্যাদায় আরও তিনজন এবং প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় চারজন বিশেষ সহকারী রয়েছেন। এর মধ্যে ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাও রয়েছেন। আচরণ বিধিমালায় নতুন এসব বিধান যুক্ত হলে তারা নির্বাচনি কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। আর অংশ নিলে তা আচরণ বিধামালা লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন।
কমিটি সূত্র জানায়, আচরণ বিধিমালায় সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তালিকায় উপদেষ্টা ও তাদের সমমর্যাদার ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে। এতে তারা নির্বাচন সময়ে সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুকূলে অনুদান ঘোষণা বা বরাদ্দ প্রদান বা অর্থ অবমুক্ত করতে পারবেন না। সরকারি কর্মসূচির সঙ্গে নির্বাচনি কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পারবেন না। এছাড়া নতুন কিছু বিধান যুক্ত করা যায় কি না- সেই আলোচনা চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থার বিধান উচ্চ আদালতে বাতিল হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নির্বাচনে নিরপেক্ষতার স্বার্থে আচরণ বিধিমালায় এসব বিধান যুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
আচরণ বিধিমালার খসড়ায় যেসব বিষয় যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জাতীয় সংসদ ভেঙে যাওয়ার সময় থেকে নির্বাচনের পরের ৪৫ দিন পর্যন্ত সময়কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার দিন থেকে তফশিল পর্যন্ত সময়কে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’; ‘তফশিল ঘোষণা থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের সময়কে ‘নির্বাচনকালীন সময়’; এবং ফলাফল গেজেট প্রকাশের পর থেকে ৪৫ দিনকে ‘নির্বাচন-পরবর্তী সময়’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আচরণ বিধিমালার প্রয়োগ ‘নির্বাচনকালীন সময়’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে নির্বাচন-পূর্ব সময় এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এই বিধিমালার মূলত কার্যকারিতা থাকবে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৮ সালে যখন আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় তখন সংসদ ভেঙে যাওয়া থেকে নির্বাচনের পরবর্তী সময় পর্যন্ত পুরোটাই ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল। তখন পুরো সময়টাই আচরণ বিধিমালা কার্যকর করার বিধান ছিল। পরে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে সংবিধান সংশোধনের পর নির্বাচন-পূর্ব সময়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে তৎকালীন কমিশন। খসড়া সংশোধনীতে আগের ওই নিয়মই পক্ষান্তরে বহাল রাখা হয়েছে।
খসড়া আচরণ বিধিমালায় নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের আগে প্রচারণা শুরুর ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হয়েছে। তবে প্রতীক বরাদ্দের আগে জনসংযোগ ও ডিজিটাল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতে পারবেন প্রার্থীরা। সেক্ষেত্রে যেসব আইডি থেকে প্রচার করা হবে তা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারে যে টাকা ব্যয় হবে তার হিসাব জমা দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে মানহানিকর কিছু করলে তা ডিজিটাল বা সাইবার সুরক্ষা আইনে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে।