
ঐক্য, সংহতি, গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের পক্ষে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। আগেও তিনি এসব ইস্যুতে কথা বলেছেন। তবে মঙ্গলবারের মতো সম্ভবত কখনোই নয়। ‘মেসেজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার’-মানবজমিনে এ শিরোনাম বহুবার ছাপা হয়েছে। সেনাপ্রধানের রাওয়ার বক্তব্য শুনে এ কথাটিই সবচেয়ে বেশিবার মনে এলো।
এর আগে আগস্টের প্রথম সপ্তায় জাতির এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ‘আমরা গুলি চালাবো না’-সশস্ত্র বাহিনীর এই অবস্থান জাতিকে একটি রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিয়েছিল। যতটা সম্ভব রক্তপাত এড়াতে চেয়েছিলেন সেনাপ্রধান। ইতিহাস নিশ্চয়ই তার এই প্রচেষ্টা স্মরণ করবে। জেনারেল ওয়াকার ক্ষমতার পথে হাঁটেননি। এমনকি জরুরি অবস্থা জারি কিংবা মৌলিক অধিকার খর্ব করে এমন কোনো পদক্ষেপও তিনি নেননি। গতকালও এটা নিশ্চিত করেছেন যে, তার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। দেশ ও জাতিকে সুন্দর জায়গায় রেখে সেনানিবাসে ফেরত যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি। সেনাপ্রধান এবং সেনাবাহিনীর এ পেশাদারিত্বের প্রশংসা করছেন অনেকেই।
গত সাত মাস বাংলাদেশ নানা ওলটপালটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। অভ্যুত্থান বা বিপ্লব যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এ ধরনের ঘটনার পর এটা কোনো অভাবনীয় পরিস্থিতি নয়। দেশে দেশে এমনটাই হয়। বাংলাদেশেও নানা অস্থিরতা। বিপ্লবের অংশীদারদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। তারা পরস্পরকে বিষোদ্গার করছেন। এমনকি কোথাও কোথাও সংঘাতেও জড়াচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অবনতি হয়েছে। এ অবস্থায় সেনাপ্রধান যে সতর্ক বার্তা বা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সহায়তা করতে পারে। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, শত্রুতা নয়। অতীতে আমরা এর বিচ্যুতি দেখেছি। পরিণতিও দেখেছি। এমন অতীতের যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সে ব্যাপারেই যেন সতর্ক করলেন সেনাপ্রধান। দেশের সবগুলো প্রতিষ্ঠান যখন ভেঙে গেছে বা ভেঙে পড়েছে তখন সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঠিক ভূমিকার ওপরই বহুলাংশে নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ।
নির্বাচন কবে হবে সেটা এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। সরকারের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে চলতি বছর ডিসেম্বর কিংবা পরের বছর মার্চের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। যদিও অনেকে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। সেনাপ্রধান এর আগে রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। গতকাল সে বার্তা আরও খোলাসা করলেন। জানালেন, ডিসেম্বর বা কাছাকাছি সময়ের মধ্যে অবাধ, স্বচ্ছ ও ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পূর্ণ একমত। সেনাপ্রধানের বক্তব্যে নির্বাচনের একটি স্পষ্ট সময়সীমা পাওয়া গেল। রাওয়ায় দেয়া বক্তব্যে সেনাপ্রধান মূলত যেসব বার্তা দিয়েছেন-
এক. ঐক্য ও সংহতির পক্ষে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন সেনাপ্রধান। উচ্চারণ করেছেন চূড়ান্ত সতর্কবার্তা। বলেছেন, ‘‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন আমি সতর্ক করিনি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি কাটাকাটি করেন, তাহলে এই দেশ ও জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।’’
দুই. নির্বাচন নিয়েও কথা বলেছেন সেনাপ্রধান। জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে কিংবা ক্লোজ টু দ্যাট টাইমের মধ্যে ফ্রি, ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সঙ্গে একমত হয়েছেন।
তিন. পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়েও নিজের অবস্থান জানিয়েছেন সেনাপ্রধান। বলেছেন, একটা জিনিস আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে। এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটা তদানীন্তন বিজিবি (তখন নাম ছিল বিডিআর) দ্বারা সংঘটিত। ফুলস্টপ। এখানে কোনো ‘ইফ’ ও ‘বাট’ নেই। পরে এটাও যোগ করেছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিংবা বাইরের কোনো শক্তি ইনভলভ ছিল কিনা সেটার তদন্তের জন্য কমিশন করা হয়েছে।
চার. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও বার্তা দিয়েছেন সেনাপ্রধান। আইনশৃঙ্খলা খারাপ হওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও বিষোদ্গারকে প্রথম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। এ ছাড়াও বলেন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই অতীতে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে। দেশ যে এত বছর স্থিতিশীল ছিল এটার কারণ হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও সিভিলিয়ান সবাই মিলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছি। সে জন্য এতদিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এর মধ্যে যারা কাজ করেছে যদি অপরাধ করে থাকে সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। নাহলে এ জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজ করবো এসব সংস্থা যেন আন্ডারমাইন না হয়।
শেষ কথা: ইতিহাসে কখনো কখনো এমন হয়। একটি জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী কিংবা সেনাপ্রধানকে সুনির্দিষ্ট কাজের বাইরে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। ভূমিকা রাখতে হয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনেও। সে ভূমিকাই আরও স্পষ্ট হলো সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যে। বাংলাদেশের ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই তাকে স্মরণ রাখবে।