Image description
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা, বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নতুন সিকিউরিটি ফোর্স গঠনের প্রস্তাব, জনবল ১০ হাজার ৬৩২, খরচ ৩৯৭ দশমিক শূন্য ২ কোটি টাকা

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (হশাআবি) নিরাপত্তার দায়িত্বে দুই সংস্থা-এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক) এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। দুই সংস্থার দ্বন্দ্ব শুরু হয় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে। বিভিন্ন সময়ে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা হলেও তা কমেনি, বরং বেড়েছে। এদিকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নতুন সিকিউরিটি ফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে অতি গোপনে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্র জানায়, দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে ১৬ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি দল পুলিশ সদর দপ্তরে যায়। দলটি পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এপিবিএন সদস্যরা বিমানবন্দরের ভেতর (এয়ারসাইটে) ৫ আগস্টের আগের মতোই দায়িত্ব পালন করবেন। এক্ষেত্রে এপিবিএন-এর পক্ষ থেকে কার্যালয় দখল এবং মালামাল খোয়া যাওয়ার অভিযোগে এভসেকের বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে যে জিডি করা হয়েছে, তা নিষ্পত্তির দাবি জানানো হয়। সে অনুযায়ী, পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি জিডির নিষ্পত্তি হয়। এর পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করতে যান এপিবিএন সদস্যরা। কিন্তু তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি। সেখানে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত এয়ারফোর্স সদস্য। হুমকি দিয়ে এপিবিএন সদস্যদের বলা হয়, খারাপ কিছু হওয়ার আগে আপনারা এখান থেকে চলে যান। রণাঙ্গন পরিস্থিতিতে পিছু হটে এপিবিএন।

বিমানবন্দর থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম ১৭ ফেব্রুয়ারি এভসেক-এপিবিএন বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত একটি অবহিতকরণ পত্র দেন একই থানার ওসিকে। ওই পত্রে বলা হয়, ৫ আগস্ট সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে এপিবিএন সদস্যরা যথারীতি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন) দেশব্যাপী পুলিশের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে এপিবিএন সদস্যরা বিমানবন্দরে স্ব স্ব ডিউটি পোস্ট থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন। ৫ আগস্টের আগে এয়ারপোর্ট এপিবিএন (১৩) বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এরিয়াসহ সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে সব পোস্টে এয়ারফোর্স সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। পাশাপাশি আগের ডিউটি পোস্টগুলোয় এপিবিএন-এর যাতায়াত সীমিত করে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে বেবিচক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়। এপিবিএন সদস্যরা যাতে আগের মতো বিমানবন্দরে সব স্থানে নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেজন্য বেবিচককে অনুরোধ জানানো হয়। এতে বিমানবাহিনীর সদস্যরা আপত্তি জানান। এ নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

অবহিতকরণপত্রে আরও বলা হয়, উভয় বাহিনীর মধ্যে নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়। ২৯ অক্টোবর অ্যাপ্রোন এরিয়া ৩৩ নম্বর গেট সংলগ্ন এপিবিএন অফিসের দাপ্তরিক নথিসহ ব্যবহৃত সামগ্রী সরিয়ে ফেলা হয়। বিষয়টি নিয়ে এপিবিএন-এর তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (বর্তমানে এসি পেট্রোল, তেজগাঁও, ডিএমপি) বিমানবন্দর থানায় একটি জিডি করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি বেবিচক চেয়ারম্যান, মেম্বার (অপারেশন্স), মেম্বার (সিকিউরিটি), নির্বাহী পরিচালক (হশাআবি), পরিচালক (এভসেক) এবং এপিবিএন দায়িত্বশীলদের সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। ফলপ্রসূ আলোচনা হওয়ায় এপিবিএন-এর পক্ষ থেকে করা আগের জিডি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়। অবহিতকরণপত্রে এসআই জাহাঙ্গীর আলম উল্লেখ করেন, ‘যেহেতু জিডির বাদী ও বিবাদীর মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে আপাতত বিষয়টির মীমাংসা হয়েছে, তাই এ মুহূর্তে আইনি পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই। তবে অভিযোগের বিষয়বস্তু অতি সংবেদনশীল। এ কারণে এয়ারপোর্ট জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এবং উত্তরা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করে ভবিষ্যতের জন্য জিডিতে নোট দিলাম।’

এদিকে বিমানবন্দরে দুই নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বন্দ্বের সুযোগে মাঝেমধ্যেই ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। ১৮ ফেব্রুয়ারির মারমুখী অবস্থা ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দরের বেশ কয়েকটি ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ৫ আগস্টের পর থেকে যাত্রী হয়রানির বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১-এর অ্যারাইভাল ক্যানোপিতে এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালককে বেধড়ক মারধরের ঘটনা আলোড়ন তুলেছে। যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে আহত করা, নারীর গায়ে ধাক্কা দেওয়া এবং ক্যানোপির ভেতর মারধরের ঘটনায় সুনাম নষ্ট হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকসহ একই পরিবারের পাঁচজনকে নাজেহালের ঘটনা গড়িয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় পর্যন্ত। এছাড়া মানব পাচারকারীকে ধরে ছেড়ে দেওয়াসহ নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্ক জন্ম দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র আরও জানায়, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স নামে নতুন সংস্থা গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি অর্গানোগ্রাম মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। অর্গানুগ্রামে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি জনবল নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। অর্গানুগ্রাম অনুযায়ী, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্সের মোট জনবল হবে ১০ হাজার ৬৩২ জন। এর প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক। মহাপরিচালকের পদে বিমানবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসতে পারেন। মোট জনবলের ৭০ ভাগ হবেন সামরিক এবং ৩০ ভাগ হবেন অসামরিক। তিনটি ধাপে এ জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রথম ধাপে ৩ হাজার ৮৯৪, দ্বিতীয় ধাপে ৩ হাজার ৪০৭ জন এবং তৃতীয় ধাপে নিয়োগ দেওয়া হবে ৩ হাজার ৩৩১ জন। মোট জনবলের ৫ হাজার ১৬৭ জনকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পদায়ন করা হবে।

দুই হাজার ৮৭৭ জনকে পদায়ন করা হবে ওসমানী, শাহ আমানত ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে। যশোর, রাজশাহী, বরিাশাল ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নিয়োগ দেওয়া হবে ২ হাজার ২৪০ জনকে। আর সদর দপ্তরে জনবল থাকবে ৩৪৮ জন। এক্ষেত্রে মোট খরচ হবে ৩৯৭ দশমিক শূন্য ২ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ১৭৫ দশমিক শূন্য ১ কোটি, দ্বিতীয় ধাপে ১১৪ দশমিক ৩৫ কোটি এবং তৃতীয় ধাপে ১০৭ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা খরচের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) দুই বাহিনীর দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, বিমানবন্দরে নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা নেই। কে কোথায় কীভাবে কাজ করবে, সেটা আমি বলে দিয়েছি। এভসেক এবং এপিবিএন যদি সমন্বয় করতে না পারে, সেটা তাদের বিষয়। তিনি বলেন, আমরা সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করছি। একটা সময় আসবে যখন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পুরো এয়ারপোর্ট নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তখন অন্য কারও সহযোগিতা লাগবে না।

হশাআবির নির্বাহী পরিচালক কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিমানবন্দরে এপিবিএন-এর সঙ্গে যেটা হয়েছে তা বড় কিছু না। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যানের সঙ্গে আইজিপি মহোদয়ের কথা হয়েছে