Image description

আগের চেয়ে জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতা আরো বাড়ছে। এবার জেলা কমিশনারকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিদ্যমান পদবি পরিবর্তন করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের নাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার এবং ইউএনওর নাম পরিবর্তন করে উপজেলা কমিশনার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব। মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪০ থেকে কমিয়ে ২৫টি করা, শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি না দেওয়ার, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ৫ শতাংশ হারে বাড়ানো, চার বিভাগকে প্রদেশ করা, প্রশাসনিক ন্যায়পাল’ নিয়োগ করা, সরকারি চাকরিতে প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই প্রথা বাতিল, বাধ্যতামূলক অবসর-ওএসডি না করা, সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন, ৩ পিএসসি গঠন করা, মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে সচিব নিয়োগের সুপারিশ, সিনিয়র সচিব নামকরণ বাদ দেওয়া, চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া, মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে জেলা-উপজেলায় নাগরিক কমিটি গঠন এবং আপত্তি থাকলেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আলাদা সার্ভিস গঠন করাসহ শতাধিক প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত হবে জুলাই সনদ-নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করার হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন তুলে দেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী। একই দিন বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনও তুলে ধরা হয়। পরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে দুই কমিশনের কিছু কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং উপ প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। এরপর প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপও সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) পদবি পরিবর্তন করে অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য যেমন সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রয়েছে, তেমনিভাবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের নিয়ে একটি করে ‘জেলা নাগরিক কমিটি’ ও উপজেলা নাগরিক কমিটি’ গঠন করা। এ কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি রাখতে হবে। ‘নাগরিক কমিটি’ সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে চার মাস অন্তর নিজেদের মধ্যে সভা করবে এবং তার কার্যবিবরণী জেলা কমিশনারের ওয়েবসাইটে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর প্রধানের কাছে পাঠাবে।

বিদ্যমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারকে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস’ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই ক্যাডার সার্ভিসের পদগুলো মাঠ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর সচিবালয় চলবে সব সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)’-এর কর্মকর্তাদের দিয়ে। এখানে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদের কর্মকর্তারা থাকবেন। ‘এসইএসে’ উপসচিব পদে প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য সার্ভিসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখা হবে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার খবরে বিসিএস ৩০ থেকে ৪১ ব্যাচ পর্যন্ত কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ। তারা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা জড়ো হয়। এ সময় প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং এই সিদ্ধান্ত তাদের প্রতি অবিচার বলে তুলে ধরেন।

মামলার ক্ষমতা দেয়ার প্রস্তাব: জেলা কমিশনারকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে। কমিশন প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে সাধারণ নাগরিকেরা সহজে মামলা করার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে সমাজের ছোটখাটো বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতের ওপর অযৌক্তিক মামলার চাপ কমবে। তবে এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী একই বিষয়ে পুনরায় আদালতে যেতে পারবেন না। এ সুপারিশের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন: কমিশনর উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কমিশন বলেছে এটি করা হলে সাধারণ নাগরিকেরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এ বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেছে কমিশন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ পদের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে থানার ‘অফিসার ইনচার্জ’ এর কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ হিসেবে পদায়ন করা যেতে পারে।

বেতন ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর সুপারিশ: স্থায়ী বেতন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের প্রতিবছর পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সরকার কমিশন।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেশের মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রদত্ত ইনডেক্স বিশ্লেষণ করে মূল বেতন প্রতিবছর বেতন বাড়ানো যেতে পারে। তবে তা ৫ শতাংশের বেশি হবে না। এ উদ্দেশ্যে একটি স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীরা ১৫ বছর চাকরি করার পর স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়লে তাদের পেনশনসহ সব ধরনের অবসর সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

চার বিভাগকে প্রদেশ করার সুপারিশ: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পুরনো ৪ বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমাতে পুরাতন চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। দেশের ৪টি প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কুমিল্লা ও ফরিদপুরকে আলাদা বিভাগ করার সুপারিশও করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় রেখে নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ বা ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সরকার কমিশন। জেলা পরিষদ বাতিল করে জেলা পরিষদের সহায়-সম্পদ প্রস্তাবিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছে সংস্কার কমিশন। ইমিগ্রেশনের জন্য পুলিশের আলাদা ইউনিট গঠনের সুপারিশ করেছে।

মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪০ থেকে কমিয়ে ২৫টি করার প্রস্তাব:
বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোকে যুক্তিসংগতভাবে কমিয়ে কমিশন সরকারের সব মন্ত্রণালয়গুলোকে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এজন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে সমপ্রকৃতির পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় এবং ৬১টি বিভাগ রয়েছে। মন্ত্রণালয় গুলোকে যুক্তিসংগতভাবে কমিয়ে কমিশন সরকারের সব মন্ত্রণালয় গুলোকে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করা। একই সঙ্গে কমিশন সব মন্ত্রণালয়কে সমপ্রকৃতির পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করছে। কমিশন ‘জনমুখী প্রশাসনের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পুনর্গঠন’ শিরোনামে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা পুনর্বিন্যাস করণ, মন্ত্রণালয় গুলোকে কয়েকটি গুচ্ছে সংগঠিতকরণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের জনবল কাঠামো পুনর্বিন্যাস, বিভিন্ন সেক্টর করপোরেশনের পুনর্বিন্যাস, মন্ত্রণালয়ের নীতি ও পরিকল্পনা কোষ শক্তিশালীকরণ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ, নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগ পৃথকীকরণ, রাজস্ব বোর্ডের নীতি ও বাস্তবায়ন পৃথকীকরণ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, নতুন প্রশাসনিক বিভাগ গঠন, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস একই কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে আনায়ন, বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়গুলো আলোচনা করে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সুপারিশমালা দিয়েছে।

সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন, ৩ পিএসসি গঠনের সুপারিশ:
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পুনর্গঠনের প্রস্তাব করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একই সাথে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়,বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় একীভূত ‘ক্যাডার’ সার্ভিস বাতিল করে তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের কাজের ধরন ও বিশেষায়িত দক্ষতার বিষয়টি সামনে রেখে আলাদা আলাদা নামকরণ করা যেতে পারে। বিদ্যমান বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারগুলোকে ১২টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস, বাংলাদেশ বিচারিক সার্ভিস, বাংলাদেশ জননিরাপত্তা সার্ভিস, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সার্ভিস, বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস, বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস, বাংলাদেশ রাজস্ব সার্ভিস, বাংলাদেশ প্রকৌশল সার্ভিস, বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস, বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিস, বাংলাদেশ তথ্য সার্ভিস এবং বাংলাদেশ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দুটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়েছিল। একটি ক্যাডার সার্ভিসের জন্য এবং অপরটি নন-ক্যাডার সার্ভিসের জন্য। পরবর্তীতে দুটিকে একীভূত করা হয়। ‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মে জনবল নিয়োগের জন্য এখন তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার সুপারিশ করা হলো। প্রতিটি কমিশনের সদস্য সংখ্যা হবে চেয়ারম্যানসহ ৮ জন। কমিশনগুলো হচ্ছে, পাবলিক সার্ভিস কমিশন (সাধারণ): শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ব্যতীত অন্য সকল সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (শিক্ষা): শুধুমাত্র শিক্ষা সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য): শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সার্ভিসে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা।

চুক্তিতে নিয়োগ দেয়ার বিধান আগের মতোই থাকছে:
মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে সচিব নিয়োগের সুপারিশ, চুক্তিতে নিয়োগ বিধান আগের মতোই থাকছে।ক্যাডার কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) বাতিল করে মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে সচিব নিয়োগের সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি অতিরিক্তি সচিবদের মধ্য থেকে বাছাই করে সচিব ও সচিবদের মধ্য থেকে মুখ্যসচিব পদে পদোন্নতির প্রস্তাব সরকার প্রধানের কাছে পেশ করবে। বর্তমান সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড বাতিল করা যেতে পারে। ‘অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকে সচিব নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনাময় কর্মকর্তাদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মত তারা যোগ্য হতে পারে। মুখ্য সচিব পদে পদায়ন নিয়ে প্রতিবেদন বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় গুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করা হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে একাধিক বিভাগ সৃষ্টি হবে। তাদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সে সকল মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একজন সচিবকে মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হলো। বর্তমান সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে এ পদে পদায়ন করা যেতে পারে।

সিনিয়র সচিব নামকরণ বাদ দেয়ার প্রস্তাব: সিনিয়র সচিব নামকরণ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব ও সচিব পদে কোনো বেতন গ্রেড বা স্কেল থাকবে না। সরকার তাদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি নির্ধারণ করবেন। কোনো কর্মচারী যদি কোনো পদে পদোন্নতির সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যান এবং এরপরে আর ইনক্রিমেন্ট না পেয়ে থাকেন এবং তিনি যদি বিভাগীয় মামালায় গুরুদ-ে দ-িত না হয়ে থাকেন, তবে তাকে দুই বছর পর, বেতন স্কেল প্রদানের সুপারিশ করা হলো। কমিশন বলেছে, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসের বাইরে ৫ শতাংশ পদে সরকার বিশেষ কোনো যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে চুক্তিভিত্তিক যুগ্মসচিব বা সংস্থা প্রধান পদে নিয়োগ দিতে পারে।

শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি না দেওয়ার সুপারিশ: সরকারি কর্মকর্তাদের শূন্য পদের বাইরে কাউকে পদোন্নতি না দেওয়ার সুপারিশ করেছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে, শূন্য পদের চেয়ে অধিক সংখ্যক পদে পদোন্নতি দিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করা হয়। এরূপ প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। কেবল মাত্র শূন্য পদের বিপরীতে সমসংখ্যক পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান করার জন্য সুপারিশ করা হলো। সব ক্যাডারের লাইন প্রমোশন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে যে বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে বিশেষ করে যেসব সার্ভিসে ১ থেকে ৪ গ্রেড পর্যন্ত পদ নেই তা সমাধানের জন্য প্রত্যেক সার্ভিসে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৪ এর প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃষ্টি করা যেতে পারে। একইভাবে নির্দিষ্ট সার্ভিসের কর্মপরিধির চাহিদার সমানুপাতিক হারে পদোন্নতির জন্য বিভিন্ন গ্রেডের পদ সৃষ্টি করার জন্য সুপারিশ করা হলো। সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের ৫ম ও ৩য় গ্রেডের সমমানের পদে পদোন্নতির জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসন ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন ঐতিহ্য ও বিধিবিধান অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানে মাঠ প্রশাসনের জন্য আলাদা আইন থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। এ কারণে মাঠ প্রশাসনে অনেক সময় বিভিন্ন সরকারি বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। এ সমস্যা দূরীকরণের জন্য মাঠ প্রশাসনের জন্য আলাদা আইন প্রণয়ন করার জন্য সুপারিশ করা হলো।

প্রশাসনিক ন্যায়পাল’ নিয়োগের সুপারিশ: সরকারি কর্মচারীদের অযাচিত হেনস্তা ঠেকাতে অতি দ্রুত প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগ ও তার সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রতিবেদন বলা হয়েছে, জনপ্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোনো কোনো সময়ে অযাচিত ও অনাকাঙ্খিতভাবে হেনস্তার শিকার হন। এরূপ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য না শুনেই কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার বা ওএসডি করা হয়। অনেক সময় সরকারি কাজ করতে গিয়ে কর্মকর্তারা মামলায় জড়িয়ে পড়েন। সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যয়ভার তাদেরকেই বহন করতে হয়। অনেকে অবসরের যাওয়ার পরেও আইনি লড়াই এবং মামলার খরচ দিতে হিমসিম খান। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসন সংক্রান্ত বিষয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুততর সময়ের মধ্যে একজন প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগ করা যেতে পারে। জাতীয় সংসদে আইন পাসের জন্য অপেক্ষা না করে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারি করে প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রশাসনিক ন্যায়পাল সরকারি কর্মচারীদের শুনানি গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে মত দিয়েছে সংস্কার কমিশন।

রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই প্রথা বাতিলের প্রস্তাব: সরকারি চাকরির নিয়োগে প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথা বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। পুলিশ ভেরিফিকেশনের বিষয়ে সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা কোনো গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথা বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা হলো। কারণ জনপ্রশাসনে রাজনীতিকীকরণ এ স্তর থেকেই শুরু হয়। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা যাবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ বিভাগের কাছে শুধু সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না সে সম্পর্কে প্রতিবেদন চাইবে। প্রয়োজনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে প্রতিবেদন চাইতে পারে। এতে বলা হয়, পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরিবর্তে প্রার্থীর যোগদানকৃত মন্ত্রণালয় সম্পাদন করবে। পাসপোর্ট, দ্বৈত নাগরিকত্ব, সমাজসেবা সংস্থা বা এনজিওর বোর্ড গঠনের মতো নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন কার্যক্রম বাতিল করার জন্যও সুপারিশ করা হলো। একজন নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র থাকলে তার বিষয় নিষ্পত্তি করা যেতে পারে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে আয়োজিত কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না মর্মে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।

বাধ্যতামূলক অবসর-ওএসডি না করার সুপারিশ:সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণের প্রথা বাতিল এবং অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) না করার সুপারিশ করেছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনে সুপারিশে বলা হয়, পাবলিক সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮ এর ধারা ৪৫ বিধান অনুসারে ২৫ বছর চাকরির পরে সরকার ইচ্ছে করলে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে বলে যে বিধান রয়েছে তা বাতিল করার জন্য সুপারিশ করা হলো। নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতীত কোনো অফিসার/কর্মচারীকে ওএসডি না করা।কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত হবে জুলাই সনদ-নির্বাচনের দিনক্ষণ: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে ছয় সংস্কার কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবিত সুপারিশ থেকে প্রয়োজনীয় সংস্কার চূড়ান্ত হবে। সংস্কার চূড়ান্ত করার পর সবাই জুলাই চার্টার (সনদ) স্বাক্ষর করবে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হবে। শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ছয়টি সংস্কার কমিশন প্রধানকে নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছেন। এ কমিশনের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রিয়াজ। অন্যান্য পাঁচ কমিশন প্রধানরা এর সদস্য। এই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা ও কথাবার্তা বলবেন। তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে কতটুকু সংস্কার এখনই করতে হবে, কতটুকু পরে করা যাবে, এখনই যা করা হবে তা করতে হলে সাংবিধানিক রিফর্ম প্রয়োজন হবে (কিছু কিছু সংস্কার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে) তা ঠিক করা হবে। বিস্তারিত আলোচনার পর অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও সুশীল নাগরিকদের সবার মতামতের ভিত্তিতে যেসব সংস্কার নিয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছাবে সেগুলোতে সবাই স্বাক্ষর করবেন। এ স্বাক্ষরের মাধ্যমে যতগুলো সংস্কার চূড়ান্ত হবে তাই হবে জুলাই চার্টার। এই জুলাই চার্টারের কিছু বাস্তবায়ন অন্তর্বর্তী সরকার করবে। কিছু পরবর্তী সরকার এসে করবে। এ বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে আগামী নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে হবে নাকি আগামী বছরের জুনের মধ্যে হবে।