Image description
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনে আটকে আছে ভোট প্রস্তুতি n সরকার থেকে নির্বাচন আয়োজনে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ ইসির

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত আগামী ডিসেম্বর মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের অংশ এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইনের সংশোধনের কারণে আটকে আছে যাবতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি। কেননা এই দুটি আইনে কী কী সংশোধন আনা হবে—সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা ছাড়া কমিশনকে কোনো ধরনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। এছাড়াও এবারের ভোটার তালিকা হালনাগাদে প্রায় ১৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৬ জন নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন যারা ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারি ভোটারযোগ্য হবেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ভোট হলে তারা ভোট দিতে পারবেন না। সব মিলিয়ে সংসদ নির্বাচনের জন্য কাঙ্ক্ষিত প্রস্তুতিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, সংস্কার কার্যক্রমের কারণে প্রস্তুতিতে আমরা আটকে আছি। এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। দুুইটি আইন সংশোধন হবে নাকি বিদ্যমান আইনে কার্যক্রম শুরু করব সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। এ বিষয়ে সময়ক্ষেপণ হলে প্রস্তুতিতে আমরা পিছিয়ে যাব। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরে নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে।

এদিকে, বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার গেটে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে যেসব সংস্কার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হবে তার ওপর নির্ভর করবে জাতীয় নির্বাচন এ বছর ডিসেম্বরে নাকি আগামী বছর জুনে হবে।

গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয় তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে আরো অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।

ইসির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত ডিসেম্বরকে টার্গেট করে প্রস্তুতি শুরু করেছিল কমিশন। সেই লক্ষ্যে গত ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম চলে। সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য ৪১টি আসনের ২৪৮টি আবেদন পড়ে। কিন্তু সংস্কার কার্যক্রমের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুতির কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না ইসি। এমনকি নির্বাচনি রোডম্যাপও করা সম্ভব হচ্ছে না। আপাতত সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে আছে ইসি। তবে এরই মধ্যে ‘জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন’ এবং ‘ভোটার তালিকা আইন’ এর খসড়া আরো যাচাইয়ের জন্য ইসির সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এ দুটি আইন সংশোধনের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করবে ইসি। তবে সীমানা নির্ধারণ আইনের ‘৮’ ধারায় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমানোর বিদ্যমান বিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজুল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ভোটার তালিকা, জাতীয় নির্বাচনে সীমানা নির্ধারণ আইন পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ হচ্ছে। আমরা এটাকে জনসংখ্যার পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থা ও অবস্থান, সর্বশেষ জনশুমারি ও ভোটার সংখ্যার সামঞ্জস্য রেখে সীমানা নির্ধারণ করতে চাচ্ছি। তবে আমরা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের অপেক্ষায় আছি।

গত ১৫ জানুয়ারি নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে আলাদা স্বাধীন কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন শর্ত শিথিলের সুপারিশ করেছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ শতাংশ জেলা এবং ৫ শতাংশ থানা অফিসের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান আইনে বলা আছে, একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয়, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয় এবং অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় থাকতে হবে। এছাড়াও ভোটার তালিকার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তপশিল ঘোষণার আগে যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশও আছে। কিন্তু সরকার থেকে উপরোক্ত নির্বাচন কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

নতুন দল নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তি জারি আটকে আছে :ইসির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইত্তেফাককে বলেন, নির্বাচন কমিশন দ্রুত নতুন দলের নিবন্ধন-বিজ্ঞপ্তি জারি করতে প্রস্তুত। কিন্তু ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবেন বলে বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ছাত্ররা কবে, কখন রাজনৈতিক দল করবেন, তারপর নতুন দল নিবন্ধনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি হবে। এতে করে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি যথেষ্ট ঘাটতি হবে। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় এক থেকে দেড়মাস সময় দিয়ে। তারপর আবেদন যাচাই-বাছাই করে মাঠ প্রশাসনের কাছে পাঠাতে হয়। এরপর ঐ তথ্য আসার পর পরবর্তী পদক্ষেপ। এই কার্যক্রম করতেও প্রায় পাঁচ মাস লেগে যাবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে অন্ধকারে ইসির সংশ্লিষ্টরা। একইভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ কাজও হচ্ছে না। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সংসদে আসন বাড়বে নাকি বিদ্যমান ৩০০ আসনে ভোট হবে, সেটিও জানে না ইসি।

একটি সূত্রমতে, সংস্কার প্রস্তাব সম্পূর্ণ করে আইন সংশোধন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে কমপক্ষে আগামী জুন-জুলাই মাস লেগে যাবে। সংস্কারের প্রক্রিয়াটি অনেকটাই মন্থরগতিতে এগোচ্ছে। ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হলে অক্টোবরের মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। তপশিলের আগে ভোটার তালিকা প্রস্তুত, নতুন দলের নিবন্ধন, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, পর্যবেক্ষক নীতিমালা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনি মালামাল ক্রয়—এসব করতে অনেক সময় লেগে যাবে ইসির। কিন্তু সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা না থাকায় এভাবে চলতে থাকলে ডিসেম্বর কোনোভাবেই ভোট করা সম্ভব নয়।

সাড়ে ১৮ লাখ ভোটার নিয়ে নতুন সমস্যা : বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে বাদ পড়া ও নতুন ভোটারযোগ্য ব্যক্তি মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ৩৮৮ জনের তথ্য সংগ্রহ করেছে ইসি। বাদ পড়া ভোটার :৩১ লাখ ২৭ হাজার ৫১৯ জন। নতুন ভোটার :১৮ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৬ জন। এবার হালনাগাদে যারা যুক্ত হচ্ছেন, তাদের কাজ জুনের মধ্যে শেষ করতে চায় ইসি। তবে নতুন ভোটার নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডিসেম্বর ভোট হলে নতুন তথ্য সংগ্রহ করা অনেকেই ভোটার তালিকাভুক্ত হতে পারবে না। আর ২ জানুয়ারির পর ভোট হলে নতুন করে যাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাদের সবাই তালিকাভুক্ত হতে পারবে। কেননা এবার যাদের জন্ম ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি বা তার আগে তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই সংখ্যা মূলত সাড়ে ১৮ লাখ। যারা ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারি ভোটার হবেন। এই নতুন ভোটারকে সামনে এনে ভোট পেছানো হতে পারে বলে ধারণা করছে ইসির সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে ২০২৬ সালের ৩ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের পর জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করে এপ্রিল-মে মাসে ভোট করার ক্ষেত্রে সরকারের আগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হতে পারে। যদিও এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসিরউদ্দিন বলেন, ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সাড়ে ১৮ লাখ ভোটার সমস্যা হবে না।

নির্বাচন বিলম্বিত নিয়ে শঙ্কা :এদিকে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের দাবিকে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার চক্রান্ত হিসেবে মনে করছেন। তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে আয়োজনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক সম্প্রতি পরিচালিত জরিপটি ছিল একপেশে। বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ বিশেষ। এছাড়াও আওয়ামী লীগের বিচার কার্যক্রম শেষ না হলে জাতীয় নির্বাচন নয়— কারোর কারোর এমন দাবিও ষড়যন্ত্র বলে অ্যাখ্যায়িত করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আপত্তি জানিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচন দিতে হবে। সংস্কার বাস্তবায়নের একমাত্র পথ নির্বাচন। বরং সংস্কারের আলাপ যত দীর্ঘায়িত হবে, দেশ তত সংকটে পড়বে। এতে সুযোগ নেবে ষড়যন্ত্রকারীরা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে নয় আমরা।’ আগামী জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানান তিনি। তবে বিএনপির দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। অন্যদিকে, জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমান জানান, জামায়াত ডিসেম্বর বা তার কিছু পরে নির্বাচনের পক্ষে।

প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনি রূপরেখা ঘোষণার আগে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছিলেন, ২০২৬ সালের জুনে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। যদিও এর আগে সেনাপ্রধান এবং সরকারের তিন জন উপদেষ্টা ২০২৫ সালে নির্বাচনের কথা বললেও সরকার থেকে সেটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এম সাখাওয়াতের বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।