Image description

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারাটা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি। এটার অর্থ- রপ্তানির ক্ষেত্রে যে ঝুঁকিটা ছিল, সেটা এখন মোটামুটি সামাল দেওয়া গেছে। কারণ প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমরা এখন বলতে গেলে ভালো অবস্থানে আছি। আমাদের প্রতিযোগীদের সঙ্গে তেমন বড় কোনো পার্থক্য নেই বরং অনেকের থেকেই কম আছে।

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা নিয়ে জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার এমন মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি ইব্রাহীম হুসাইন অভি।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমাদের শুধু ট্যারিফ হ্রাসের কারণে রপ্তানি বেড়ে যাবে এমনটা না। আমাদের কিছু মৌলিক সমস্যা আছে, বিশেষ করে সরবরাহ ব্যবস্থার দিক থেকে। সেগুলো ঠিক করতে হবে। তাহলেই আমরা এই সুযোগগুলো বাস্তবে কাজে লাগাতে পারব।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। আপনি কি মনে করেন ২০ শতাংশ শুল্কের হারটা সহনীয়?

ড. জাহিদ হোসেন: যদিও ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়া নিঃসন্দেহে উন্নতি, কিন্তু ২০ শতাংশও আমদের জন্য এখনো বেশি। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, আগের মতো ঝুঁকির মধ্যে আর নেই আমরা। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় এখন আমাদের কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে। তবে শুধু ট্যারিফের কারণে রপ্তানি বেড়ে যাবে এমনটা না। আমাদের যেটা করতে হবে তা হলো- যেসব মৌলিক সমস্যা আছে, বিশেষ করে সরবরাহ ব্যবস্থার দিক থেকে, সেগুলো ঠিক করতে হবে। তাহলেই আমরা এই সুযোগগুলো বাস্তবে কাজে লাগাতে পারব।

তাহলে আপনার দৃষ্টিতে পুরো বিষয়টা কতটা ইতিবাচক?

ড. জাহিদ হোসেন: আমি বলব, এটা খুবই ইতিবাচক একটা অগ্রগতি। এক সময় যেভাবে ভারতের কারণে বাজার হারানোর ভয় ছিল, এখন বরং কিছু অংশ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের উচিত এই সুযোগ কাজে লাগানো। বিশেষ করে যারা দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি দিতে পারবে, তারাই সুবিধা পাবে।

শুরু থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছে ভারত। শুধু গার্মেন্টস না, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জুতা, প্লাস্টিকসহ আরও বেশ কিছু পণ্যে ভারত আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। ধারণা করা হয়েছিল ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ১ শতাংশ দখল করে ফেলবে। যদি আমাদের ট্যারিফ ৩৫ শতাংশ আর ভারতের ২৬ শতাংশ হতো তাহলে পরিস্থিতি আমাদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হয়ে যেতো। তবে এখন দৃশ্যপট বদলেছে। ভারতের ট্যারিফ ২৫ শতাংশ করা হয়েছে, সঙ্গে রয়েছে পেনাল্টি। যা প্রায় ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত, ধরুন যদি ভারতের ওপর কোনো অতিরিক্ত চাপ বা পেনাল্টি না-ও থাকতো, তবুও আমাদের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ।

আগের যে ধারণা ছিল- ভারত আমাদের মার্কেট দখল করে ফেলবে, এখন বরং বাংলাদেশই ভারতের কাছ থেকে কিছু মার্কেট শেয়ার আদায় করতে পারবে। শর্ত একটাই- আমাদের সাপ্লাই ও ডেলিভারি ঠিকঠাক দিতে হবে। এখানেই একটা সমস্যা আছে। আমাদের ডেলিভারি ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে।

যদিও শুল্ক হারে আমরা ভিয়েতনামের কাছাকাছি অবস্থানে আছি, ভিয়েতনাম কিন্তু চীনের ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর আলাদা রেট (শুল্ক সুবিধা) রয়েছে। আমাদের ক্ষেত্রে এমন কোনো কিছু নেই। এই দিক থেকে, ভিয়েতনামের সঙ্গেও আমাদের কিছুটা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা রয়েছে।

রপ্তানি হারানোর যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল সেদিক দিয়ে এখন কি মার্কেট রিকভার করতে পারবে?

ড. জাহিদ হোসেন: হ্যাঁ, তবে সেটা নির্ভর করবে আমরা কতটা দক্ষভাবে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজ করতে পারি তার ওপর। আমাদের ডেলিভারি ব্যবস্থায় সমস্যা আছে, সেটা ঠিক করতে পারলে আমরাও বাজারে শক্ত অবস্থানে যেতে পারব। ভিয়েতনামের মতো দেশ কিছু নির্দিষ্ট সাপ্লাই শিপমেন্টে সুবিধা পায়, সেটা আমাদের নেই। তবে এখন কিছু ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তাহলে কি গার্মেন্টস খাতে আর সমস্যা হবে না? গার্মেন্টস রপ্তানিকারকরা কি এখন ভালো করতে পারবে?

ড. জাহিদ হোসেন: ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় আমরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। তবে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ধরুন, পাকিস্তানেও যদি ট্যারিফ এক পার্সেন্ট কম হয়, তবু অনেক ব্র্যান্ড সেদিকে যাবে না। কারণ পাকিস্তানের উৎপাদন সক্ষমতা নেই এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। তারা আগে থেকেই বাংলাদেশে এসেছে কারণ, এখানে উৎপাদনের পরিকাঠামো ছিল।

আমাদের যে মৌলিক কিছু সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান না হলে শুধু ট্যারিফ কমলেই লাভ হবে না। যেমন ধরুন গ্যাসের সংকটে অনেক কারখানাই ঠিকমতো চলতে পারে না। ফলে, নির্দিষ্ট সময়ে ডেলিভারি দেওয়া যায় না। রাস্তাঘাটে যদি অস্থিরতা বা অশান্তি থাকে, তাহলে পণ্যবাহী ট্রাক ঠিকমতো চলতে পারে না। অনেক সময় এয়ার ফ্রেইট করতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু তাতেও সমস্যা। কারণ মালামাল চট্টগ্রামে সময়মতো পৌঁছে না। এগুলো হচ্ছে সবচেয়ে মৌলিক চ্যালেঞ্জ।

অনেক সময় কনটেইনার বন্দরে পড়ে থাকে। পড়ে থাকতে থাকতে বিলম্ব হয়। ডকুমেন্ট ক্লিয়ারেন্স (শুল্ক ফাঁকি বা দেরি) হয় না। এনবিআরের সঙ্গে প্রক্রিয়াগত জটিলতাও আছে। এসব কারণে অপ্রয়োজনীয় সময় নষ্ট হয়, ফলে লিড টাইম বেড়ে যায়। অর্থাৎ, পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে বেশি। এই ধরনের সাপ্লাই চেইন সমস্যাগুলো যদি আমরা নিজেরা ঠিক করতে না পারি, তাহলে দায়টা আমাদেরই। ট্যারিফ কমার কারণে যে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে মার্কেটে, সেটা তখন কাজে লাগানো কঠিন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ তৈরি পশাকে ৪০ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশনের শর্তের বিষয়টি আমাদের রপ্তানিতে প্রভাব ফেলতে পারে কি না?

ড. জাহিদ হোসেন: আলোচনা হলেও স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যালু অ্যাডিশনের সংজ্ঞা একটু ভিন্ন- তারা লাভকে বিবেচনা করে না। শুধু শ্রম ও স্থানীয় উপাদানকে গণনা করে। এতে আমাদের ভ্যালু অ্যাডিশন কম দেখায়, কিন্তু এটা সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য।

যেহেতু আমদানিকৃত কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক থেকে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন অর্জন করা প্রায় অসম্ভব, আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই শর্ত পূরণ করতে হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাপড়ের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এর জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পে আরও বিনিয়োগ অপরিহার্য। সরকারকে নীতি সহায়তার মাধ্যমে বিনিয়োগে উৎসাহী করতে হবে।

ভবিষ্যতে কি এই হার আবার পরিবর্তিত হতে পারে?

ড. জাহিদ হোসেন: অবশ্যই সম্ভব। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় কিছু ব্যাপার আলাদা ছিল এবং ভবিষ্যতে তারা আবার দুই দেশের মধ্যে আলাদা চুক্তি করতে পারে। তবে আপাতত, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আগামীতে আরও কর হার কমানোর জন্য কী করা যেতে পারে?

ড. জাহিদ হোসেন: ট্যারিফের হার আরও কমাতে হলে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। তবে আমাদের ট্রাম্প প্রশাসনের বার্তাটি ভালোভাবে বুঝতে হবে।। এক্ষেত্রে সরকার এবং শিল্পখাত সংশ্লিষ্টদের শ্রমিক অধিকার, পরিবেশ সংক্রান্ত অনুবর্তিতা, দুর্নীতি রোধ এবং ব্যবসা পরিচালনার প্রক্রিয়া আরও সহজ করার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকার বারবার উল্লেখ করেছে। এসব বিষয় ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরও ভালোভাবে ট্যারিফ সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে ট্যারিফ হারের আরও উন্নয়ন এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণেরও আশা করা যায়।এর পাশাপাশি, সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর দিকেও নজর দেওয়া। তবে সেটা করতে হবে দেশীয় ব্যবসার স্বার্থ এবং জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রেখেই। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও কিছু পণ্য আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।