Image description
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষিত, মাফিয়ারা অধরা

নানা উদ্যোগ নিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত মাফিয়াদের। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অস্বাভাবিকভাবে টিকিটের দাম বাড়িয়ে যাত্রীদের পকেট কাটছে-এ সিন্ডিকেট। মন্ত্রণালয় বিদেশি এয়ারলাইন্সের জিএসএ ও বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ওঠা কারসাজির অভিযোগের সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য-প্রমাণসহ পেয়েছে। তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ ও শোকজও করা হয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বরং উল্টো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মনগড়া মূল্যবৃদ্ধি করে যাত্রীদের পকেট কাটছে। টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বড় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যগামী শ্রমিকসহ অন্যান্য যাত্রীরা। এ ছাড়া ওমরাহ পালন করতে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিমানের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির খেসারত দিচ্ছেন। অথচ বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আকাশ পথে যাত্রী সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের কোনো অ্যাকশন দেখা যাচ্ছে না। কয়েকটি এজেন্সি ও জিএসএকে শোকজ দিয়ে দায় সেরেছেন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শ্রমিক ও ওমরাহ যাত্রীদের টার্গেট করে মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক অন্তত ১১টি এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশি জিএসএ ও ৩০/৩৫টি অসাধু ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মিলে দেশ জুড়ে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা গ্রুপ টিকিটের নামে ভুয়া তথ্য দিয়ে টিকিট ব্লক করে রাখে। একেকটি ফ্লাইটের দুই তৃতীয়াংশ সিট ব্লক করে রাখে। এভাবে সিট ব্লক করে রাখলে ফ্লাইটে সিট স্বল্পতা দেখা দেয়। তখন টিকিটের দাম বেড়ে যায়। আর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেট ব্লক করা টিকিট বিক্রি শুরু করে। এভাবে কেনা দামের চেয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ দামে তারা টিকিট বিক্রি করে। 

যাত্রীরা জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো রুটের বিশেষ করে সৌদি আরবের টিকিট যেন সোনার হরিণ। রিয়াদ-দাম্মাম-জেদ্দা-মদিনা রুটের টিকিট যেখানে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায় পাওয়া যেতো সেখানে এখন ৮০ হাজার টাকায়ও মিলছে না। জুলাই মাসেও কম দামে টিকিট পেয়েছেন যাত্রীরা। এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এই টিকিটের দাম নেমে এসেছিল ৩০ থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে। ঢাকা কুয়েত, ঢাকা রিয়াদ, ঢাকা দাম্মামসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের টিকিটের দাম চড়া। ঢাকা থেকে কুয়েতগামী যাত্রীরা টিকিট কিনছেন ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায়। রিয়াদের টিকিট পাওয়ার জন্য গুনতে হচ্ছে ১ লাখ টাকা।
ট্রাভেল এজেন্সির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছু এজেন্সি গ্রুপ আকারে যাত্রীর নাম ছাড়া টিকিট ব্লক করে রাখে। কিছু ক্ষেত্রে যাত্রীর নাম দিয়ে বুক করলেও যাত্রার আগে নাম পরিবর্তন করে দেয়। অথচ সরকার গত ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট কপি ছাড়া বুকিং করা যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায়ও বলা হয়েছে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ব্যতীত কোনো টিকিট বিক্রি করা যাবে না। টিকিটের গায়েও তা উল্লেখ থাকতে হবে। আগে যারা নাম ছাড়া টিকিট মজুত করতো তারা আবার সক্রিয় এবং এয়ারলাইন্সের টিকিট অগ্রিম নাম ছাড়া ব্লক করে তারা মজুত করছে তাই আবারো টিকিটের দাম আকাশচুম্বী। নাম ছাড়া টিকিট বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। এয়ারলাইন্সের জিএসএগুলো তাদের লাভের একটি অন্যতম খাত হিসেবে বিবেচনা করে অগ্রিম টিকিট ব্লক করে এবং নিম্নমূল্যের  টিকিটগুলো ব্লক করে তাদের পছন্দের কয়েকটি সিন্ডিকেট এজেন্সির মাধ্যমে বাজারে ২০০ থেকে ৩০০ ডলার বাড়তি দামে বিক্রি করে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি এ বিষয়ে তদন্ত করে কি ব্যবস্থা নিয়েছে তা প্রকাশ পায়নি।

গত ২১শে আগস্ট মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মির্জা মুরাদ হাসান বেগ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আকাশপথের যাত্রী এবং ট্রাভেল এজেন্সির মালিকদের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১১ই ফেব্রুয়ারি-২০২৫ তারিখে জারিকৃত পরিপত্রে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধকল্পে যে নির্দেশনাসমূহ প্রদান করা হয়েছিল তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। উক্ত পরিপত্রে টিকিটের গায়ে বিক্রয়মূল্যের উল্লেখ করার নির্দেশনা থাকলেও তা অনুসরণ না করার নজির দেখা যাচ্ছে। আকাশপথের যাত্রী সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণার্থে সকল ট্রাভেল এজেন্সিকে এয়ার টিকিটের গায়ে ট্রাভেল এজেন্সির নাম, লাইসেন্স নম্বর এবং টিকিটের বিক্রয়মূল্য স্পষ্ট ভাষায় লিখতে হবে। আকাশপথের যাত্রী সাধারণকেও ক্রয়কৃত টিকিটের বিক্রয়মূল্য এবং ট্রাভেল এজেন্সির নাম যথাযথ রয়েছে কিনা বুঝে নিতে হবে। কোনো ভাবে অনিবন্ধিত ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট ক্রয় করা যাবে না। কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বা সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে উক্ত ট্রাভেল এজেন্সির নিবন্ধন বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এর আগে আকাশপথের যাত্রীসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রতারণা রোধে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি ১১টি এয়ারলাইন্সের জিএসএদের ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে সিন্ডিকেট করে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণার প্রমাণ পায়। পরে তাদের এ নিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। যাদের নোটিশ দেয়া হয় তাদের মধ্যে রয়েছে, সালাম এয়ারের জিএসএ এম এ লতিফ শাহরিয়ার জাহেদী, এয়ার এরাবিয়ার জিএসএ আব্দুর রহিম, জাজিরা এয়ারওয়েজের জিএসএ মেরিনা আহমেদ, সৌদি এয়ারলাইন্সের জিএসএ আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ, ফ্লাই দুবাই জিএসএ ইসমাইল আর চৌধুরী। একইভাবে ৩০টি ট্রাভেলস এজেন্সির বিরুদ্ধে জিএসএদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে বিমান ভাড়া বাড়ানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে তাদেরও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। যাদের নোটিশ দেয়া হয়েছে সেই ট্রাভেল এজেন্সি হলো- নড়িয়া টাভেলস অ্যান্ড ট্যুরের সবুজ মুন্সী, হাজী এয়ার ট্রাভেলসের নির্মল চন্দ্র বৈরাগী, ট্রাভেলস চাম্প লিমিটেডের দিলরুবা পারভীন, মাদারস লাভ এয়ার ট্রাভেলসের শরিফ ভূঁইয়া, টেক ট্রিপ লিমিটেডের দিলরুবা পারভীন, ভ্যালেন্সিয়ার এয়ার ট্র্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরের এফ আর করিম কাজল, টেকঅপ ট্রাভেলসের শাহজিয়া আফরিন, মেঘা ইন্টারন্যাশনাল এয়ার সার্ভিসের শফিকুল হাসান বাশার, কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনালের কাজী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান, জেএস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুারের এনামুল হক বাবুল, বি ফ্রেশ লিমিটেডের মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম, বিনিময় ইন্টারন্যাশনালের গিয়াস উদ্দিন রতন, ইস্টওয়েস্ট ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরের মাহমুদুল হাসান, কিং এয়ার এভিয়েশনের ওহিদুল ইসলাম চৌধুরী, সাদিয়া ট্রাভেলসের মোহাম্মদ রওশন আলী, গালফ ট্রাভেলসের মোহাম্মদ শাহ আলম, এআর তাহেরা ট্রাভেলসের আকবর আলী, ইলহাম  ট্রাভেলস করপোরেশনের মোহাম্মদ জোমান চৌধুরী, আল গাজী ট্রাভেলসের সায়েম এম হাসান, সানশাইন এক্সপ্রেস ট্রাভেলসের মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, গোল্ডেন বেঙ্গল ট্যুরস ট্রাভেলসের ফরিদ আহমেদ মজুমদার, আরবিসি ইন্টারন্যাশনালের জাহিদুল ইসলাম চৌধুরী, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলস এজেন্সির শহিদুল ইসলাম চৌধুরী, টাইমস এক্সপ্রেস লিমিটেডের মাহবুবুল হাবীব, ফ্লাই ফেয়ার ট্রাভেলসের আবদুল্লাহ আল নোমান।

১৩ই জুলাই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কারণ দর্শানোর নোটিশে জিএসএদের বলা হয়, যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের ফটোকপি ব্যতীত গ্রুপ বুকিংসহ যে কোনো প্রকার টিকিট বুকিং বন্ধ করা সত্ত্বেও  কতিপয় ট্রাভেল এজেন্সি ও ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে ব্লক করে রাখা টিকিট বিক্রয়ের প্রস্তাবের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গিয়েছে। এর আগে ২৭শে ফেব্রুয়ারি ট্রাভেল এজেন্সিকে দেয়া নোটিশে বলা হয়, এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে প্রদত্ত নির্দেশনা অমান্য করে ট্রাভেল এজেন্সি গ্রুপ বুকিংয়ের নামে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের ফটোকপি ব্যতিরেকে টিকিট বুকিং ও বুকিংকৃত টিকিট উচ্চমূল্যে বিক্রয় করছে। এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটি সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। জিএসএ ও ট্রাভেলস এজেন্সিকে দেয়া নোটিশে জিএসএদের পারমিট ও ট্রাভেল এজেন্সিদের লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা হয়েছে। 

এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ মানবজমিনকে বলেন, কিছু জিএসএ ও অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি যাত্রীদের জিম্মি করে লাভবান হচ্ছে। তারা গ্রুপ টিকিটের নামে টিকিট ব্লক করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পরে সুযোগ বুঝে উচ্চদামে বিক্রি করে। একটা ফ্লাইটে ৩০০ সিট থাকলে তারা যদি ২০০ ব্লক করে রাখে তবে অটোমেটিক টিকিটের দাম বেড়ে যায়। মন্ত্রণালয় যাত্রীদের নাম, পাসপোর্ট নম্বরসহ টিকিট বুকিং করার নির্দেশনা দিলেও চক্রের সদস্যরা এসব নিয়ম মানছে না। আমরা এসব বিষয় নিয়ে একাধিকবার তথ্য-প্রমাণসহ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে তদন্ত করেছে। তারা অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে। কিন্তু কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।