Image description

রাজধানীর ফুটপাথে সেই পুরনো চিত্র। দখল-চাঁদাবাজি চলছে আগের মতোই; বরং কোথাও কোথাও চাঁদার রেট বেড়েছে। বেড়েছে দোকানের সংখ্যা। রীতিমতো পুরো ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) তথ্য বলছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগর এলাকার ৩৮ শতাংশ মানুষ হেঁটে গন্তব্যে যান। আর এসটিপি’র-২০২৫ এর তথ্য বলছে, এই পায়ে হেঁটে চলা মানুষগুলোর জন্য থাকা ঢাকার ১৬৩টি ফুটপাথের অন্তত ১০৮ কিলোমিটার অংশ ব্যাপকভাবে অবৈধ দখলের কবলে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় বছরে যেখান থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা চাঁদা ওঠানো হয়। যার নিয়ন্ত্রণ খোদ দুই সিটি করপোরেশনও করতে পারছে না।   

সরজমিন রাজধানীর গুলিস্থান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জিরো পয়েন্ট থেকে গোলাপ শাহ্‌ মাজার হয়ে তাঁতী বাজারের দিকে যেতেই রাস্তার দুই পাশ দখল করে বসেছে শত শত ভ্রাম্যমাণ দোকান। টি-শার্ট, প্যান্ট, শার্ট, বাচ্চাদের জামা-কাপড়সহ নানা ধরনের পোশাক নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ফুটপাথ দখল করে এসব দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড়ে ছোট-বড় যানবাহন তো দূরের কথা পায়ে হেঁটে পথ চলাও দায়। এই রাস্তার মাথায় গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচের অংশেও বসানো হয়েছে সারি সারি জুতার দোকান। এদিকে জিপিও’র সামনে হয়ে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট দিয়ে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশ দিয়েও রয়েছে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে পাতাল মার্কেটের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে যেতে ফুটপাথের ওপর ছাউনি দিয়ে দুই পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দোকান। মানুষ চলাচলের ফুটপাথে তৈরি হওয়া এসব অস্থায়ী দোকান বছরের পর বছর ধরে রূপ নিয়েছে স্থায়ী দোকানে। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের মূল রাস্তা দখল করে বসানো হয়েছে একাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান। সকালে ফাঁকা রাস্তাটি দিয়ে সহজেই গাড়ি চলাচল করলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাসমান দোকানে পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সামনে দিয়ে ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তার ওপর বসানো হয়েছে হকারি দোকান। আর এসব দোকানে পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির পার্কিং করা দূরপাল্লার গাড়িতে পুরো গুলিস্থান এলাকা জুড়ে নিত্যদিন তৈরি করছে অসহনীয় যানজট। 

সাইফুল ইসলাম নামে এক পথচারী বলেন, ফুটপাথ তো হকারদের জন্য, আমাদের জন্য না। যদি আমাদের হতো তাহলে এভাবে দখল করে ব্যবসা করতে পারতো না কেউ। এদের কারণে আমরা ফুটপাথ রেখে রাস্তায় নামতে বাধ্য হই। আর বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় পড়তে হয়। কোনো সরকারেরই এগুলো চোখে বাধে না। রাব্বি নামে এক হাকারি ব্যবসায়ী বলেন, আসলে এই সব দোকান ও দোকানের জায়গা আগে থেকে নির্ধারিত। প্রতি ৫০ ইঞ্চি জায়গা নিয়ে একটা ভিটি বা ভ্যানগাড়ির দোকান নির্ধারণ করা হয়। কে কোথায় বসবে, কার সামনে বসবে সবই আগে থেকে ঠিক করা থাকে। এসব দোকান পেতে বছরে এককালীন ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। দোকান পাওয়ার পর দিনপ্রতি দিতে হয় ৩০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা। আবার কেউ কেউ বছর চুক্তিতে না নিয়ে দিন চুক্তিতেও দোকান নেয়। দিনপ্রতি ২শ’ থেকে ৪শ’ টাকা দিয়ে দোকান নিয়ে বসে। যেদিন বসবে না আগে থেকে বলে দিতে হয়। তখন অন্য দোকানি সেখানে বসে। সোজা কথায় এই ভিটের জায়গায় যে দোকান বসাবে তাকেই টাকা দিতে হবে। টাকা না দিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। তিনি বলেন, এই গুলিস্তান এলাকায় এপাশ-ওপাশ দিয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার ভিটি আছে। শুধু ভিটি না এসব দোকানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েও আলাদা টাকা আদায় করা হয়। পুরো গুলিস্তানের এলাকাকে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে প্রতিদিনই কয়েক লাখ টাকা চাঁদা উঠানো হয়। তিনি বলেন, আগে যারা এই চাঁদার টাকা উঠাতো তারা এখন সবাই পলাতক। এখন নতুন নেতা, নতুন লাইনম্যান। বায়তুল মোকাররম থেকে ঢাকা ট্রেড সেন্টার পর্যন্ত হাজার হাজার দোকান থেকেও ৫০ হাজার টাকা এডভান্স ও মাসে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয় বলেও জানান তিনি। 

এদিকে রাজধানীর নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর রোডের দু‘পাশ, ঢাকা কলেজের সামনে, গ্লোব মার্কেটের সামনে, ধানমণ্ডি হকার্সের সামনেসহ সিটি কলেজ-সাইন্সল্যাব থেকে শুরু করে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত পুরো এলাকার ফুটপাথ প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার হকারদের দখলে।  শুধু ফুটপাথই নয় সড়কের মাঝের ডিভাইডারের উপরও বসানো হয় হকারি দোকান। এতে পুরো নিউমার্কেট এলাকায় দিনভর তীব্র যানজট লেগেই থাকে। যার কারণে পথচারীদের চরম ভোগান্তি  পোহাতে হয়। 

আর এই অবৈধ দখলের নেপথ্যেও রয়েছে বিরাট অঙ্কের চাঁদাবাজি। এসব হকারি দোকানিরা বলেন, সাধারণত স্থানভেদে এই চাঁদার পরিমাণ কমে-বাড়ে। গ্লোব মার্কেটের সামনের ফুটপাথে মাসে দোকান প্রতি ১২ হাজার, চন্দ্রিমার সামনে মাসে ৮ হাজার, নূর জাহানের সামনে মাসে ১৫ হাজার, হকার্স মার্কেটের সামনে মাসে ১২-১৫ হাজার, গাউছিয়া মার্কেটের সামনে মাসে ১১-১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হয়। এ ছাড়াও দিনপ্রতি একটা চাঁদা দিতে হয়। বিদ্যুৎ বিলের টাকা আলাদা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি বলেন, বর্তমানে সায়েন্স ল্যাব, ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট ও এলিফ্যান্ট রোড, কফি হাউজের গলি ও বাটা সিগন্যালের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন চঞ্চল ও নিজামের লোক। ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাথের নিয়ন্ত্রণ সাগর, তারেক জামিল ও পারভেজের হাতে। এ ছাড়া নীলক্ষেতের বই মার্কেট থেকে কাঁটাবনের গাউসুল আজম মার্কেটের সামনে পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন পাটোয়ারি।

দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ফার্মগেটের ফুটপাথগুলো। পুরো ফুটপাথ জুড়েই গিজগিজ করছে দোকান। পথচারীদের হাঁটার জায়গা দখল করে নানা রকমের বাজার সাজিয়ে রেখেছে অবৈধ দখলদার। হাঁটার মতো পরিস্থিতি নেই সেখানে। তাই বাধ্য হয়ে পথচারীরা নেমে যাচ্ছেন মূল সড়কে। যে কারণে যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটছে, সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ফার্মগেটের ফুটপাথের দোকানি মোস্তাক আহমেদ বলেন, টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। মানুষও হাঁটুক আমাদেরও ব্যবসা হোক। ফুটপাথে দোকান না বসালে কই যামু, বাজারে দোকানঘর নেয়ার মতো তো পুঁজি নাই। তাই প্রতিদিন লাইনম্যানকে টাকা দিয়ে দোকান চালাই। রবিউল ইসলাম। সাত বছর ধরে এখানে দোকান চালায়। মৌসুম বুঝে বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা করি। ব্যবসার খাতিরে দোকান চালাতে গিয়ে অনেকবার উচ্ছেদ হয়েছি কিন্তু আবার ফিরে এসেছি। নগদ টাকা লাইনম্যানকে দিয়ে ব্যবসা করে টিকে আছি। আসলে আমাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। আমরা পেটের দায়ে এখানে বসেছি। আমি না বসলে আরেকজন এসে বসবে।

 সিন্ডিকেটের প্রতিদিনের চাঁদা আদায় ঠিকই চলবে। তারা প্রশাসনকেও টাকা দেয়। তাই তাদের কেউ কিছু বলতে পারে না। তিনি বলেন, শার্ট, প্যান্টের ছোট দোকানের জন্য প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আর জুতা ও আরেকটু বড় দোকানের জন্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। কিন্তু এসব টাকা মূলত কাদের হাতে যাচ্ছে এর উত্তর দিতে নারাজ তারা। তাদের ভাষ্য- তারা শুধু লাইনম্যানকেই চেনেন।

মিরপুর ১০ নম্বরের ফুটপাথেও পা ফেলার জায়গা নেই। মূল সড়কের পাশে ৩০ ফুট চওড়া ফুটপাথ থাকলেও সেখানে ২-৩ স্তরে দোকান বসেছে। একই অবস্থা মিরপুর ১ নম্বরের। মুক্তবাংলা শপিং সেন্টারের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, শাহ আলী মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেটের সামনে ফুটপাথসহ মূল সড়ক দখল করে বসে শত শত দোকান। ফলে এখান দিয়ে হেঁটে চলাই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী এলাকাও হকারি দোকানিদের দখলে। এলাকাটির ফ্লাইওভারের নিচে সকাল থেকে প্রায় সারাদিনই বসে মাছের বাজার। সড়কের উপরে মাছের বাজার বসার কারণে দূরপাল্লার বাসগুলো ঢাকা থেকে বের হতে ও প্রবেশ করতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ ছাড়া ঢাকার ভিআইপি এলাকায় ধানমণ্ডি, উত্তরা, গুলশান, বনানী এলাকার ফুটপাথেও আগের চেয়ে কয়েকগুণ দোকান বসানো হয়েছে। ছোট ছোট ভ্যানে টং দোকান বানিয়ে ফুটপাথের উপর বসানো হচ্ছে বিভিন্ন খাবার ও পণ্যের দোকান। এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এসব দোকানের জন্য জায়গা নিতে হয়। তারপরও মাসিক চুক্তি ও দিন প্রতি এসব দোকানগুলোকে চাঁদার টাকা দিতে হয়। আর এসব দোকানের জন্য ফুটপাথ দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল দায় হয়ে গেছে।
এসব বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা হাসিবা খান বলেন, রাস্তা ও ফুটপাথ দুটোই সিটি করপোরেশনের। তবে ফুটপাথ দখলমুক্ত করা এককভাবে সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব বাহিনী নেই, যেটা পুলিশের আছে। এরপরও আমাদের স্বল্প জনবল দিয়ে দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিত ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নিয়ম ভঙ্গ করে যদি কেউ ফুটপাথ দখল করে তাদের সরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের। তাই আমাদের সকলেরই এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।  

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগে. জেনা. মো. মঈন উদ্দিন বলেন, ঢাকা শহরে যেই রাস্তাগুলো আছে ও ফুটপাথগুলো আছে তা পর্যাপ্ত। এখানে সমস্যা হচ্ছে রাস্তাগুলোকে আমরা ফ্রি রাখতে পারছি না, ফুটপাথগুলোকে আমরা ফ্রি রাখতে পারছি না। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী নেতারা এসব অবৈধ দখলদারদের সুযোগ করে দেন। কারণ স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী যেসব নেতা আছেন, তারা এখান থেকে সুবিধা পান। এদের উঠিয়ে দিলেই আবার নেতাদের নাম বলে। তারপরও আমরা নিয়মিত অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছি।