Image description

ছিল নৌকার শ্রমিক। অন্যের হয়ে বালু লুট করতো। ৫০০ টাকা রোজেও কাজ করতো। সেই শ্রমিক এখন কোটিপতি। মাত্র তিন মাসে বালু লুটে দু’হাতে টাকা কামাই করেছে। পুলিশের সঙ্গে এখন দহরম-মহরম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ দেয়া হলেও নীরব থাকছে প্রশাসন। তার নাম আব্বাস উদ্দিন। গোয়াইনঘাটের বাংলাবাজার এলাকার রাউত গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামের পাশেই ‘বালুর হাওর’। জাফলং থেকে আসা পিয়াইন নদীতেই এই বালুর হাওরের অবস্থান। সাদাপাথর লুটের পর যখন গোটা জেলা জুড়ে তোলপাড় চলছে তখনো বালুর হাওর সরব। রাত হলেই শুরু হয় লুটপাট। চলে ভোর পর্যন্ত। বালু শ্রমিকরা জানিয়েছেন- আগে ওই এলাকা থেকে দিনে শত শত ভলগেট বালু লুট করা হলেও এখন কমেছে। বর্তমানে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ ভলগেট বালু লুট করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- বাংলাবাজার হচ্ছে জাফলংয়ের ভাটির জনপদ। লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকে ওই এলাকা।

বাংলাবাজারের পার্শ্ববর্তী যে গ্রাম বালু রাজ্য সেটি হচ্ছে বালুর হাওর। এই হাওরের পাশেই রাউত গ্রাম। এ গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় আব্বাস উদ্দিন গোটা বছরই বালু শ্রমিকের কাজ করতো। অন্যের নৌকা দিয়ে কয়েক বছর ধরে বালু শ্রমিকের কাজ করতো। আর ওখান থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে সংসার চালাতো। জাফলংয়ের বালু লুটে ভাটা পড়ার পর বালুর হাওরে চোখ পড়ে খেকোদের। স্থানীয় লোক হওয়ার কারণে আব্বাসের নেতৃত্বে তিন মাস ধরে ওই স্থান থেকে বালু লুট শুরু করে। তার রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। তারা স্থানীয় বিট পুলিশের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চালায় লুটপাট। প্রথম ৩ মাসে দিনে ও রাতে চলে বালু লুটপাট। ১৫ থেকে ২০ হাজার ফুটের ভলগেট দিয়ে বালু লুট করা হয়। এতে ভেঙে গেছে জনপদ। তাদের বালু লুটপাটের ফলে কয়েক বিঘা গো-চারণ ভূমি এরই মধ্যে নদীতে তলিয়ে গেছে। তারা জানিয়েছেন- ওই এলাকা থেকে উত্তোলিত প্রতিফুট বালু থেকে আব্বাস উদ্দিন ৪ টাকা হারে গ্রহণ করেছে। প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি ফুট বালু লুটপাট করা হয়েছে ওই এলাকা থেকে। বালু লুটের টাকা দিয়ে আব্বাস স্টিল বডির বালুবাহী নৌকা কেনা শুরু করে। এ পর্যন্ত সে চারটি বালুর নৌকা ক্রয় করেছে। একেকটি নৌকার মূল্য ৩০ লাখ টাকা। সিলেটের বাইরে থেকে আসা বালুর নৌকা ছাড়াও তার নিজের কেনা নৌকা দিয়ে বালু লুটপাট চালায়। 

১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দিয়ে একটি বড় ভলগেট কেনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দামে বনিবনা না হওয়ায় পরে কেনা হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাবাজার এলাকার বালু ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন- মাত্র তিন মাসে বালু লুটে আব্বাসের এই উত্থান চোখে পড়ার মতো। গোয়াইনঘাট থানার সাব-ইন্সপেক্টর ও স্থানীয় বিট কর্মকর্তা উৎসব কর্মকারকে ‘ম্যানেজ’ করে সে বালু লুটের মহোৎসব চালায়। প্রতিদিন এসআই উৎসবের পকেটে গেছে অর্ধলাখ টাকা। ফলে পুলিশ তার প্রতি সবসময়ই সদয় ছিল এবং লুটপাটে তাকে সহযোগিতা করেছে। স্থানীয় হুয়াউড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন- আব্বাস উদ্দিনের নেতৃত্বে যে এলাকা থেকে বালু লুট করা হচ্ছে সেটি হুয়াউড়া গ্রামের পাট্টার জায়গা। নিজস্ব জমি ছাড়াও সরকারি খাস জমি রয়েছে। কিন্তু আব্বাস বাহিনী ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে ওই এলাকায় লুটপাট চালিয়েছে। আব্বাসের সহযোগী কামরুল ইসলাম হুরুনাও দুটি নৌকার মালিক হয়েছে। 

৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে হুরুনা এই নৌকা কিনেছে। এ ছাড়া তার সহযোগী থাকা ১০-১২ জনের মধ্যে একেকজন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মালিক হয়েছে। হুয়াউড়া গ্রামের জমি থেকে বালু লুটপাটের জন্য ইতিমধ্যে সামাজিকভাবে বিচারপ্রার্থী হয়েছিলেন গ্রামের লোকজন। এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি রক্ষায় কয়েক দফা বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বালু লুট বন্ধের নির্দেশ দেয়া হলেও সেটি মানা হয়নি। বরং লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করে আব্বাস বালু লুট অব্যাহত রাখে। এই অবস্থায় গত ১৬ই আগস্ট হুয়াউড়া গ্রামের বাসিন্দারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওই এলাকায় বালু লুটে বাধা দেন। এ সময় বাইরে থেকে আসা নৌকার মাঝিরা চলে গেলেও আব্বাস তার নিজের ক্রয় করা দুটি নৌকায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু লুটপাট চালিয়ে যায়। এ সময় হুয়াউড়া গ্রামের লোকজন একটি ড্রেজারসহ আব্বাসের বালুভর্তি দুটি নৌকা আটক করেন। 

এ ঘটনায় গত ৫ দিন আগে গোয়াইনঘাট থানায় অভিযোগ দেন হুয়াউড়া গ্রামের বাসিন্দা হবিবুর রহমান। কিন্তু গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ রহস্যজনক কারণে মামলা রেকর্ড করেনি। উল্টো বালু লুটপাটে ব্যবহৃত নৌকার জন্য আব্বাসের পক্ষ থেকে থানায় আরেকটি অভিযোগ করা হয়েছে। আব্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল দুপুরে বালুর হাওর এলাকা পরিদর্শন করেছেন গোয়াইনঘাট থানার ওসি তদন্ত কবির আহমদ। তার উপস্থিতিতেই আব্বাসের পক্ষের লোকজন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাইলে পুলিশ অ্যাকশনে যায়। পরে বাধাদানকারীরা ওই এলাকা থেকে চলে যায়। মামলার বাদী হবিবুর রহমান জানিয়েছেন- বালু লুটের টাকায় পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে আব্বাস জোরপূর্বক আমাদের ভূমি দখলে নিয়ে লুটপাট করছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করা হলে পুলিশ রহস্যময় ভূমিকা পালন করছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা রেকর্ড করেনি। 

হুয়াউড়া গ্রামের আল-আমীন জানিয়েছেন- নৌ-শ্রমিক আব্বাস এখন কোটিপতি। সে চারটি নৌকা ক্রয়ের পর এখন ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দিয়ে ভলগেট কেনার চেষ্টা করছে। পুলিশের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত থাকার কারণে বালু লুট চলছে বলে জানান তিনি। তবে বালু লুট ও নৌকা কেনার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আব্বাস উদ্দিন। তিনি জানান- গ্রামের লোকজন মিলে বালু হাওরের বালু বিক্রি করছেন। সবাই মিলে টাকা নিয়েছেন, এখনো নিচ্ছেন। এখানে তার একক কোনো দায় নেই। বালু বিক্রি করে তিনি কোটিপতি নয়, ২০-২৫ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গোয়াইনঘাট থানার ওসি তদন্ত কবির আহমদ জানিয়েছেন- চাঁদাবাজির ধারায় এজাহার দেয়ায় সেটি রেকর্ড করা হচ্ছে না। ওসি তোফায়েল আহমদ ছুটিতে থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। ওসি কর্মস্থলে ফেরার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তবে এলাকায় গিয়ে তিনি তদন্ত করে এসেছেন। বালু লুটের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।