Image description
দফায় দফায় বৈঠক পুনর্জীবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার

কী ঘটছে পর্দার অন্তরালে? ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূম্রজাল- যে শব্দেই বিভূষিত করা হোক না কেন, মানুষের মনে এ প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে নানামাত্রিক তৎপরতা। সেটি যতটা না প্রকাশ্যে, তার চেয়ে বেশি পর্দার অন্তরালে। ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের খসড়া ঘোষণার পর পশ্চিমা লবির দৌড়ঝাঁপ চোখেপড়ার মতো। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলার পরপরই তারা ছুটছেন প্রধান বিচারপতির কাছে। কী আলোচনা, কী অ্যাজেন্ডা- এসবের কিছুই স্পষ্ট নয়। এর মধ্যে গত ১৮ আগস্ট সোমবার রাতে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে তার সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই প্রভাবশালী উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিনিধিরা। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সাক্ষাতের পরই উপদেষ্টা এবং ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করে। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এ অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের কথা দুটি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রগুলো বলছে, ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনড়। হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া রাষ্ট্রের স্তম্ভ¢গুলোর বিদ্যমান অবস্থার মধ্যে কী করে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দেয়া যায়Ñ সেই প্রচেষ্টায়ই মনযোগী সরকার। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ-ভারত এবং তাদের অভিন্ন স্বরে কথা বলতে থাকা দেশের গুটিকয়েক রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। এ কারণে ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাকে বারবার স্পষ্ট করতে হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অন্তর্বর্তী সরকার কী করে বিশ্বদরবারে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করবে এখন চলছে সেই প্রাণান্ত প্রয়াস।

শেখ হাসিনা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে গেছেন। ৫ আগস্ট হাসিনা রেজিমের পতনের পর গত বছর ১৭ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের দুটি ধারা (নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত বিধান) বাতিল করেন। সেই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং আইনের আরো চারটি ধারা বাতিল করেন।

গত বছর ১৮ আগস্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি। অন্য চার ব্যক্তি হলেনÑ তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জোবায়রুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমান। ওই রিটের শুনানি নিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে নাÑ তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পরে এই রুলের শুনানিতে বিএনপি, জামায়াত, ইনসানিয়াত বিপ্লবসহ কয়েকটি দল পক্ষভুক্ত হয়। অন্যদিকে, গত অক্টোবরে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৭টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও হাইকোর্টে একটি রিট করেন। পৃথক দুই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে উপরোক্ত রায় আসে।

এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুর হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ যে রায় দেন সেটির পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছর অক্টোবরে আরেকটি আবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে রিভিউ পিটিশন করেন ‘সুজন’ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক। ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার। সেই রিভিউ শুনানির তারিখ রয়েছে আগামী ২৬ আগস্ট। আইনজ্ঞদের একটি অংশ বলছে, হাইকোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ইতোমধ্যে পুনর্জীবিত হয়ে গেছে। আরেকটি অংশ বলছে, শেখ হাসিনা আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই সেটি সংসদে সংবিধান সংশোধনী এনে করেছেন। এ কারণে আদালতের রায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসবে না। এ জন্য সংসদে বিল আনতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক পুনর্জীবিতকরণের বিষয়টি সংসদের মাধ্যমে করতে হবে। ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ এটি রেক্টিফাই করে নিতে পারে।

বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারই নির্বাচনের ৯০ দিন আগে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এ পরিণত হবে। এবং এই কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। সেই সরকারে কিছু উপদেষ্টার রদবদল হবে। সরকারের কলেবর ছোট হবে। কিছু উপদেষ্টা বাদ পড়বেন। সরকারে অন্তর্ভুক্ত হবেন কিছু নতুন মুখ। বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন সেটি হুবহু পুনর্জীবিত হলে সেই কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। এখন পর্যন্ত ‘সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত’ প্রধান বিচারপতি হিসেবে রয়েছেন ওবায়দুল হাসান। তারও আগের অবসরপ্রাপ্ত রয়েছেন হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। দুজনই হাসিনার দলদাস হওয়ার দোষে দুষ্ট। তাহলে বিকল্প কী?

সূত্রগুলো আভাস দিচ্ছে, পর্দার অন্তরালের ঘটনা আবর্তিত হচ্ছে এ বিষয়টি নিয়েই। ধারণা করা হচ্ছে, কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হলে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে যেতে পারেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কেয়ারটেকার সরকারের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি’ হতে পারেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তার কোনো দলীয় তকমা নেই। স্বাভাবিক নিয়মে ৬৭ বছর পূর্ণ করে তার অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে চলতি বছর ২৮ ডিসেম্বর। অন্যদিকে নির্বাচনের ৯০ দিন আগের হিসাবে কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে চলতি বছর নভেম্বরে। এ হিসাবে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ কেয়াটেকারে বসতে পারেন না। বিকল্প হচ্ছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রধান বিচারপতির স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। সে ক্ষেত্রে ‘সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি’ হিসেবে ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ হতে পারেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। অন্যদিকে সিনিয়রিটি বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হতে পারেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম। তিনি ২০২৬ সালের ১৫ জুলাই স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে। এ পরিকল্পনায় প্রধান বিচারপতির নীতিগত সম্মতি গ্রহণেই তার সঙ্গে দেশি-বিদেশিদের দফায় দফায় সাক্ষাৎ ও বৈঠক।

পশ্চিমা কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ : বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন পদ্ধতি এবং সুশাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের আগ্রহ সবসময়ই বেশি। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, ভারত-চীন-রাশিয়ার নতুন মেরুকরণÑ সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তাদের এক ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে চায়। বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক আগ্রহ নতুন নয়। কিন্তু এবারের সক্রিয়তা ও সময়সীমা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতিফলন, তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও একটি বার্তা। ভোটারদের অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিশ্ব¦ এখন বাংলাদেশকে প্রত্যাশার চাপে রাখছে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে দেশের ভেতর এবং দেশের বাইরের সমর্থন প্রয়োজন ড. ইউনূস সরকারের। উভয় কারণে কূটনীতিকদের এ তৎপরতাকে তাৎপর্যবহ মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঘটনার ধারাক্রম লক্ষ করলে দেখা যায়, গত ১৫ আগস্ট দুপুরে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন।

১৮ আগস্ট রাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার বাসভবনে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাত ১০টা থেকে দুই ঘণ্টা ধরে চলে এ বৈঠক। গোয়েন্দা সূত্রগুলোর তথ্য মতে, ওই দিন দিবাগত রাত ১০টায় উপদেষ্টাদের ফ্ল্যাগবিহীন দুটি গাড়ি প্রবেশ করে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে। ওই গাড়িতে ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আলী রীয়াজ এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। বলা বাহুল্য, চারজনই পশ্চিমা লবির মানুষ হিসেবে পরিচিত।

সূত্রগুলোর দাবিÑ আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে বৈঠকে। নানা সীমাবদ্ধতার ভেতরও কী করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান উপহার দেয়া সম্ভব, দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের প্রতিপাদ্য ছিল এটি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কেয়ারটেকার সরকার গঠন নিয়েও কথা হয়। প্রধান বিচারপতিকে তারা একটি বার্তা পৌঁছে দেন। কিন্তু সেই ‘বার্তা’ কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার বার্তা কি না সেটি জানাতে পারেনি গোয়েন্দা সূত্রটি।

এদিকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অধ্যাদেশ উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল হয়েছে। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা স্বয়ংক্রীয়ভাবে পুনর্জীবিত হয়েছে বলে মনে করেন কোনো সংবিধান বিশ্লেষক। কিন্তু এ অবস্থায় বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা সম্ভব কি নাÑ জানতে চাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে কেয়ারটেকার সরকার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছিল। এ রকম সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলে বর্তমান চিফ জাস্টিসের নেতৃত্বেও কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হতে পারে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কেয়ারটেকার সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আদালত যদি পুরো কেয়ারটেকার ব্যবস্থা রি-স্টোর করে এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতি যদি কেয়ারটেকারের চিফ হতে সম্মত থাকেন তাহলে সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না থাকলে এটি অত্যন্ত জটিল।

তবে এ সম্ভাব্যতাকে সম্পূর্ণ নাকচ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতিকে অবসরে যেতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে যদি আগাম স্বেচ্ছায় অবসরে যান তাহলে তাকে কেয়ারটেকার চিফ করা যাবে না। কারণ এটি ‘অবসর’ হবে না, হবে ‘পদত্যাগ’। কেয়ারটেকার চিফ হিসেবে সর্বশেষ অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতির কথা বলা হয়েছে।

এদিকে ১৮ আগস্ট দুজন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ দুই কর্মকর্তা বৈঠকের পর ১৯ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে তার দফতরে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। সুপ্রিম কোর্ট দফতর থেকে জানানো হয়, প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তিতে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। বিগত এক বছরে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রচেষ্টা ও কর্মপরিকল্পনার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী দিনগুলোয় দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতির বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশি কূটনীতিকদের এমন দৌড়ঝাঁপ দেখে দেশের মানুষ অভ্যস্ত। সাড়ে তিন দশকের ইতিহাস রোমন্থনে দেখা যায়, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরও রাজনীতিতে বিদেশিদের তৎপরতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে এর প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক ফল বয়ে এনেছে, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু সব রাজনৈতিক দলের অভিন্ন বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। হাসিনার অধীনের নির্বাচনগুলোতে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করত। পাশ্চাত্যঘেঁষা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সময় নাক গলাচ্ছেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ের এসব তৎপরতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানামুখী আলোচনা। এ আলোচনা প্রকাশ্যের চেয়ে গোপনে হচ্ছে বেশি। এখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজছেন। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্টেসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সে সময়কার আলোচিত নাম। রাজনীতিতে তাদের হস্তক্ষেপ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সত্য প্রমাণিত হয় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্টেসিয়া বিউটেনিসের তারবার্তা থেকে। তখন জানা যায়, ওই সময় ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা কূটনীতিকরা ‘কফি গ্রুপ’ নামে একটি বৈঠক বসাতেন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি এবং আমন্ত্রণপত্রপ্রাপ্ত জাপান অংশ নিত। এ সময় তারা বাংলাদেশের রাজনীতি পর্যালোচনা করতেন।
হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশে এখন আলোচনার কেন্দ্রে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ও তার কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান। গেল কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের এই প্রতিনিধিরা একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লন্ডনে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ট্রেসি জ্যাকবসন। গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলাকালে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। পরে বাংলাদেশে ফিরে ট্রেসি জ্যাকবসন এবং সারাহ কুক অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ধারাবাহিকতায় সাক্ষাৎ করেন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে। একটি শক্তিশালী বিচার বিভাগ গঠনে যুক্তরাজ্যের সহায়তার আশ্বাস দেন সারাহ কুক। এ ধরনের সাক্ষাৎ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিদেশিরা করতেই পারেন বলে মন্তব্য করেন অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ।