
একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আনোয়ারা বেগম। বয়স ৬৭। শেষ বয়সে সন্তান পরিবার-পরিজন নিয়ে আয়েশে জীবন কাটানোর কথা। কিন্তু এই বয়সে তার ঠিকানা হয়েছে কারাগার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক হত্যা মামলায় আসামি হয়ে কারাবাসে তিনি। বিএনপি’র সমর্থক হয়েও মামলাগুলোতে ‘ট্যাগ’ দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ নেত্রীর। অভিযোগ রয়েছে, সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে নিজ গর্ভে ধারণ করা সন্তানই ষড়যন্ত্র করে মামলার আসামি করেছেন তাকে। ভুক্তভোগী আনোয়ারার পরিবারের সদস্য ও আইনজীবী জানান, সম্পূর্ণ ভুয়া মামলায় ষড়যন্ত্র করে তাকে আসামির তালিকায় ঢুকানো হয়েছে। এমনকি ঢাকার দুইটি থানার মামলার গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদনে আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে আনা হত্যা মামলায় সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও ছেলে তৌহিদ আনোয়ার অভিকের ষড়যন্ত্র থমকে দিয়েছে তার কারামুক্তির পথ। আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের হয় কারাগারে যাওয়ার পরপর। এতে আসামি হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির পেছনে ছেলে অভিকেরই সরাসরি ইন্ধন রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজন ও আইনজীবীরা।
তারা জানান, ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত কার হাউজ লিমিটেডের জমির অর্ধাংশের কর্ণধার আনোয়ারা বেগম। ২০২৩ সালে স্বামী মারা যান। তারপর থেকে তিন ছেলেমেয়ে বাবার অংশের মালিকানা ভোগ করছেন। এরই মধ্যে ছোট ছেলে তৌহিদ আনোয়ার অভিক গত দুই বছর ধরে মায়ের অংশ হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছেন। কিন্তু সফল হননি। গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার ঘটনার পর একে একে তিনটি মামলার আসামি হন আনোয়ারা বেগম। আকস্মিকভাবে মামলার আসামি হওয়ার পরপরই ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রথমে যাত্রাবাড়ী থানায় গত ৩রা মার্চ মামলার ১৬৭ নম্বর আসামি হন আনোয়ারা বেগম। এক মাস পর ৪ঠা মে উত্তরার পূর্ব থানার একটি মামলায় ১৪০ নম্বর আসামি করা হয় তাকে। এ ছাড়া গত ২৪শে জুলাই আরেকটি মামলায় ৬৪ নম্বর আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয় ৬৭ বছর বয়সী এই নারীকে। তিনটি মামলাই জুলাই অভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতা হত্যার ঘটনায় দায়ের করা। শুধু তাই নয়, এসব মামলায় আনোয়ারা বেগমের ভাই মেজবাহ উদ্দিন লিটন, বোন জাহানারা বেগম ছাড়াও তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক, কার হাউজের ম্যানেজারসহ ঘনিষ্ঠদের নাম আনা হয়েছে।
আনোয়ারা বেগমের ভাই মেজবাহ উদ্দিন লিটন বলেন, আমার বোন সাধারণ একজন মানুষ। কার হাউজের অর্ধেক মালিকানা তার। কিন্তু আনোয়ারা বেগমের স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই তাদের ছোট ছেলে তৌহিদ আনোয়ার অভিক নানাভাবে চেষ্টা করছে পুরো সম্পত্তি নিজ নামে করার। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে সেটা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। মা আনোয়ারা বেগমকে বারবার চাপ প্রয়োগও করেন অভিক। কিন্তু পরাস্ত হয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার ঘটনায় চারটি মামলায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করান সুকৌশলে। আমরা জানতে পেরেছি ‘মামলাবাজ’ ব্যক্তিদের ধরে টাকার বিনিময়ে আনোয়ারা বেগমের নাম মামলায় দেয়া হয়।
লিটন আরও বলেন, শুধুমাত্র সম্পত্তির লোভে নিজ গর্ভধারিণী মাকে এইভাবে হেনস্তা করার নজির আর দেখিনি। আমার বোনের বয়স ৬৭ বছর। এই বয়সে আরাম আয়েশ করবেন। তার জায়গায় কারাগারে পড়ে আছেন। নিরপরাধী একজন মানুষ আজ কতোগুলো দিন তিনি কারাগারে অবস্থান করছেন। আমি নিজেও ওই হেনস্তার শিকার। আমার নামেও মামলা দেয়া হয়েছে। আমার আরেক বোন জাহানারা বেগমকেও আসামি করা হয়।
লিটনের ভাষ্যে, আমার বোন আনোয়ারা বেগম কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তিনি একজন বিএনপি’র সদস্য। নারায়ণগঞ্জ মহানগরের বিএনপি’র সদস্য তিনি। অথচ মামলায় তাকে আওয়ামী লীগ নেত্রী উল্লেখ করা হয়।
এদিকে, বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি বন্দর উপজেলার ৮১ জন সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে। এর আনোয়ারা বেগম মধ্যে ৫৪তম সদস্য। নারায়ণঞ্জ বিএনপি’র মহানগরের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এডভোকেট জাকির হোসেনের অনুমোদন দেয়া তালিকাটিও মানবজমিন সংগ্রহ করেছে।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৯ই জুলাই ৫৪ ধারায় আনোয়ারা বেগমকে আটক করে পুলিশ। পরদিনই তাকে আদালতে চালান করলে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তারপর ৬ই আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একইভাবে ১২ই আগস্ট উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। একইভাবে মোহাম্মদপুর থানার মামলায়ও গ্রেপ্তার বিষয়ে আগামী ২৭শে আগস্ট শুনানির অপেক্ষায় রয়েছেন আনোয়ারা বেগম।
আনোয়ারা বেগমের আইনজীবী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের হওয়া দুই মামলা থেকে জামিন পেয়েছেন তিনি। এসব মামলায় পুলিশ আদালতকে দেয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, হত্যা ঘটনার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি আনোয়ারা বেগমের। এমনকি মামলার বাদীপক্ষের কাছ থেকেও কোনো স্বাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
আনোয়ারা বেগমের আইনজীবীরা জানান, গত ১৮ই আগস্ট ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়া উদ্দিন আহমেদের আদালত যাত্রাবাড়ীর হত্যা মামলায় জামিন দেন। এ ছাড়া ১৯শে আগস্ট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিএম ফারহান ইশতিয়াকের আদালত উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় তাকে জামিন দেন। কিন্তু ২০শে আগস্ট এমএম ১৭ এর বিচারক আরিফুল ইসলামের আদালত আনোয়ারা বেগমের মামলায় পিডব্লিউ ইস্যু করেন। এটি বিধিবহির্ভূত বলেও মনে করেন আইনজীবীরা।
মামলার আইনজীবী এডভোকেট রিয়াদ মানবজমিনকে বলেন, আনোয়ারা বেগমের মামলার তথ্য উদ্ঘাটন করে দেখা যায় তিনি শুধুমাত্র পারিবারিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাগারে বন্দি রয়েছেন। যেসব মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তার কোনোটির সঙ্গেই এই বয়স্ক নারীর সম্পৃক্ততা নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠী শুধু আনোয়ারা বেগমকেই নয় অনেক মানুষকে হয়রানি করছে। যা নাগরিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে। আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি এটি নিছকই একটি সম্পত্তি দখলের চেষ্টা।
অভিযোগের বিষয়ে আনোয়ারা বেগমের ছেলে তৌহিদ আনোয়ার অভিক বলেন, স্বজনদের আনা অভিযোগ সত্য নয়। তিনি এক বছর যাবত অসুস্থ।