
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক স্পষ্ট উচ্চারণের নাম। সমসাময়িক রাজনীতি, নির্বাচন, সংস্কার ও তরুণদের ভূমিকা নিয়ে তিনি বরাবরই সরব। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের পর তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও ভাবনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। তিনি শুধু রাজনীতির একজন কুশলী নন, বরং একজন চিন্তাশীল, তরুণবান্ধব ও সাহসী নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছেন। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, জবাবদিহির দাবি ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনা তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। দেশের রাজনৈতিক গতিপথ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, শিক্ষাব্যবস্থা এবং তরুণ নেতৃত্ব নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ জুল আর্শিল।
এনডিএম-এর যাত্রা ৮ বছর পূর্ণ করলো। শুরুর প্রত্যাশাগুলোর কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে?
আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম, সেটার সবটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা বলা যাবে না। এটা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা মনে করি যে, অনেকদূর একটা বিশাল ধাপ আমরা এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। এনডিএম জন্ম নেয় একটা বিশ্বাসের ভিত্তিতে। বিশ্বাসটা হলো জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্র পুরো বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা। তো, আমরা ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত যে একটা স্বৈরশাসনে আবদ্ধ ছিলাম, যেখানে গণতন্ত্র ছিল না, জবাবদিহিতা ছিল না। সে জায়গা থেকে আমরা সকলে একত্রিতভাবে আন্দোলন করে এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে সক্ষম হলাম, আমার মনে হয় বিশাল একটা স্টেপ আমরা পার করেছি। তাই আমি বলব, আমরা যে কারণে আমাদের যাত্রা শুরু করেছি তার আশেপাশেও আমরা হয়ত যেতে পারিনি, তবে অনেক দূর আমরা আসতে সক্ষম হয়েছি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি চলছে। এক বছর আগে যে প্রত্যাশা ছিল নতুন বাংলাদেশকে নতুনভাবে দেখার, তার কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন?
গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের সবার অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আছে। সবাই অনেক কষ্ট করেছি, তারপর বিজয়টা অর্জিত হয়েছে। তাই, এটা যেহেতু আমাদের অনেক কষ্টের অর্জন, সত্যিই আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এর সাথে কিছু অবাস্তব প্রত্যাশাও থাকবে, এটাও স্বাভাবিক। তো, সেরকম শুধু আমার না, সব ধরনের মানুষেরই তেমন প্রত্যাশা ছিল। আমরা কিছু জায়গায় আশাহত হয়েছি। তবে বাস্তবিকভাবে অর্জন অনেক হয়েছে। জাতীয়তাভাবে অর্জন অনেক হয়েছে। আমাদের যত আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল সব পূরণ হয়েছে তা না, কিন্তু কিছু পূরণ হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই পূরণ কতটুকু হয়েছে তা না, গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা এই পূরণ করার যাত্রায় কতটুকু নিবেদিত হয়েছি। এটা যেহেতু হয়েছে, সেহেতু এটা আজ-কাল আমরা পূরণ করতে পারব।
আপনি একটি স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যেখানে আপনি ১৬ বছর ধরে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। জুলাই আন্দোলনের সময় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবরুদ্ধ ছিল, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই রাজপথে সরব হয়ে আন্দোলনে নতুন মাত্রা এনেছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর দেখা গেল তারা ক্লাসে ফিরে গেল, আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা নানা সুবিধা ভোগ করল। এই বৈষম্য আপনি একজন শিক্ষক হিসেবে কীভাবে দেখেন?
বেশ কয়েকটি বিষয় আছে এখানে। একটা হলো যে, জুলাইয়ের ১৮, ১৯, ২০ এই তিনদিন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, এর সাথে স্কুল, কলেজ ছিল, মাদ্রাসা ছিল, তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যদি নেমে না আসতো, তবে ১৭ তারিখ রাতেই এই আন্দোলনের ইতি টানা হতো৷ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা যখন নেমে এসেছে, তাদের সাথেও আমি ছিলাম ১৭, ১৮, ১৯ তারিখে। এর আগেও আমরা রাজপথে ছিলাম তখন শিক্ষার্থীদের সাথে আমরা ছিলাম না। তো, ১৮, ১৯, ২০ যখন ছাত্রদের সাথে ছিলাম, তখন একটা জিনিস পরিষ্কার ছিল যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি ধারা যোগ করে এই ১৮, ১৯, ২০ তারিখ। কারণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একেকজন একেকভাবে কথাটা নিতে পারে। তবে যেকোনো সমাজে এলিট শ্রেণি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এজন্যই এদের এলিট বলা হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রছাত্রী যারা আছেন, তাদের বড় একটা অংশ এলিট পরিবারের সন্তান। তো, এলিট পরিবারের সন্তানরা যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসলো এবং তারপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের উপর যখন আক্রমণ হলো, এইটা রাতারাতি পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো৷ একটা হলো, অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীরা রাজপথ দখল করতে সক্ষম হলো, আর আরেকটা হলো, তাদের উপর যখন আক্রমণ হলো, তাদের পরিবারবর্গও একরাতে সরকার-বিরোধী হয়ে গেল। আমি আগেও বলেছি, এসব পরিবারবর্গ সমাজের এলিট শ্রেণি, যেহেতু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ তারা বহন করতে পারে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা তাদের আছে। এরপর সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে, এটা অসম্ভব হয়ে গেল। তারপর সময়ের ব্যাপার ছিল এবং ২/৩ সপ্তাহের মধ্যে সরকার চলেও গেল। তাই, এই ১৮, ১৯, ২০ পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বড় অবদান রাখে স্বৈরাচার সরকার পতনে।
এখন আসি ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে। প্রথমত তারা তাদের ক্যাম্পাসে পড়াশোনায় ফিরে যায়। কারণ তরুণদের দায়িত্ব ওই জায়গায়। সরকার পরিচালনা করা তরুণদের দায়িত্ব না। কিন্তু আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনে অনেক বিশাল কিছু ভুল আমরা দেখি। তখন হয়ত এত বিশাল ভুল মনে হয়নি। কিন্তু, এটা এখন পরিষ্কার ভুল যে সরকার গঠনে তরুণদের অংশগ্রহণ। একাত্তরে কিন্তু আসলেই বিপ্লব হয়েছিল, জুলাই কিন্ত বিপ্লব না, এটা গণ-অভ্যুত্থান। একাত্তরে বিপ্লব হবার পর, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ যারা সরকারি পরিচালানায় ছিলেন তারা মিলেই কিন্ত সরকার গঠনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কোনো ছাত্রযোদ্ধা গিয়ে পার্লামেন্টে হঠাৎ করে বসেননি এবং নির্বাচন হয়েছিল। মানে ৭৩-এর নির্বাচন। আর ৭২ এ যে টেম্পোরারি সরকার দায়িত্ব নেয়, ৭০ এর নির্বাচন জয়ী কাঠামোগত সরকার। তো, এখানে তরুণরা কিন্তু সরকারে বসেন নাই। তাই এটা বিশাল একটা ভুল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বারা হয়েছে। যেটি এখনো তারা টেনে যাচ্ছে। এই যে আমরা একটার পর একটা দেখছি যে এক তরুণ উপদেষ্টা বন্দুকের সামঞ্জস্য নিয়ে এয়ারপোর্টে ধরা পরেন। এবং এটা পুরোপুরি অবৈধ। মানে কোনোভাবে তার লাইসেন্স থাকতে পারে না, বাংলাদেশের আইনে সম্ভবই না। আরেকজন তরুণ উপদেষ্টা বলছেন মব ভায়োলেন্স ভালো। রাস্তাঘাটে সম্মিলিতভাবে পেটাচ্ছেন, এটা ভালো। তারা তরুণ, তাদের আমি দোষও দিই না। আমি দোষ দিই যারা তাদেরকে সরকারে অংশ করেছেন। এই জায়গা থেকে আপনি বলতেই পারেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক মূল্যায়ন হয়েছে। উল্টোদিকে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা এর ভেতরে জড়াননি। হ্যাঁ, তাদেরকে কিছু জায়গায় অসম্মান করা হয়েছে, এটাও আমি দেখেছি এবং খুব দুঃখের সাথে দেখেছি। কিন্ত আমি বিশ্বাস করি, আগামীর ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই রয়েছে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ যখন উঠেছে, তখন আরেকটি বিষয় জানতে চাই। আপনি কী মনে করেন—জাতীয় সংসদে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা আগামীতে অংশ নিতে পারবে? কারণ জুলাই আন্দোলনের বড় একটি সাফল্য তো এসেছিল তাদের নেতৃত্ব থেকেই।
আমি মনে করি, আপনি বিষয়টিকে কিছুটা সরলভাবে দেখছেন। প্রথমত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি ধারণা। এর যাত্রা শুরু হয় মাত্র ১৯৯২ সালে। এরপর ’৯০ দশকের শেষদিকে গিয়ে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে ভর্তি হতে শুরু করে। অর্থাৎ, বড়জোর ২৫ বছরের ইতিহাস। প্রথমদিকে খুব অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী ছিল, পরে ধীরে ধীরে সেই সংখ্যা বেড়েছে। আর জাতীয় সংসদ এমন এক জায়গা যেখানে কেবল ডিগ্রি থাকলেই হয় না, প্রয়োজন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, মাঠের বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান এবং জনগণের আস্থা। এসব অর্জন করতে সময় লাগে, বয়স লাগে, ধারাবাহিকতা লাগে।
আমরা সর্বশেষ অংগ্রগ্রহণমূলক নির্বাচন দিখেছি ২০০৮-২০০৯ সালে। এরপর ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। সে সময় পর্যন্ত যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে, তাদের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। ফলে সংসদে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের উপস্থিতি কম। এটা খুব স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে, তাদের পরিবারের আর্থিক বিনিয়োগ অনেক বেশি থাকে। স্বভাবতই পরিবারগুলো চায় না তাদের সন্তানরা রাজনীতির মতো ঝুঁকিপূর্ণ পথে হেঁটে যাক। তারা পছন্দ করে নিরাপদ, সম্মানজনক পেশায় যাওয়া। যেমন কর্পোরেট, আইটি, অ্যাকাডেমিক বা উদ্যোক্তা খাতে। যার ফলে রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ কম।
তৃতীয়ত, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র রাজনীতিকে অনেকটা রিক্রুটমেন্ট প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে। এবং তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরই বেশি ফোকাস করে। কেননা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পারিবারিক চাপ তুলনামূলকভাবে কম, তারা রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হতে অপেক্ষাকৃত স্বাধীন।
প্রধান এই তিনটি কারণেই আপনি সংসদে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম দেখবেন। তবে সময় বদলাচ্ছে। এখনকার তরুণরা অনেক বেশি সচেতন, প্রযুক্তিসম্পৃক্ত এবং নেতৃত্বদানের মানসিকতাসম্পন্ন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে আমরা আরও বেশি করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা তরুণদের রাজনীতিতে, এমনকি সংসদেও দেখতে পাব।
বর্তমানে পিআর সিস্টেম নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। আমরা এটাও দেখছি যে পিআর সিস্টেম নিয়ে এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদ, চরমোনাই ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের একই বক্তব্য দিচ্ছে। এনডিএম-এর চেয়ারম্যান হিসেবে আপনার বার্তা কী?
আমাদের বার্তা স্পষ্ট—আমরা যখন নতুন গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করেছি, তখন কিছু দলের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থের জন্য এই প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত নয়। পিআর সিস্টেম নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে এর প্রকৃত রূপটি বোঝা দরকার। বাংলাদেশে এনডিএম-ই প্রথম দল হিসেবে অফিসিয়ালি পিআর সিস্টেম চালুর দাবি তোলে। তবে আমরা বলেছি, এটা হতে হবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে—এক কক্ষে পিআর, আরেক কক্ষে এফপিটিপি। এতে রাজনৈতিক ভারসাম্য রাখা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে যেসব দল সম্পূর্ণ পিআর চাইছে, তাদের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র নয়, বরং দলীয় স্বার্থ। কারণ তারা বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির আলোচনায় প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি, এটা তো ওপেন সিক্রেট।
মার ধারণা, তারা এটা একটি নেগোসিয়েশনের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এই কৌশল ক্ষতিকর, কারণ সম্পূর্ণ পিআর ব্যবস্থা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। পিআর মানে আপনি ব্যক্তিকে ভোট দেবেন না, দেবেন দলকে। এতে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা উঠে যায়, জবাবদিহিতাহীন রাজনীতি জন্ম নেয়। আপনার এলাকায় কে সাংসদ তা আপনি জানবেন না, কারণ পিআর সিস্টেমে আসনভিত্তিক প্রতিনিধি থাকে না। বাংলাদেশের মতো বাস্তবতায়, এটি দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, গণতন্ত্র নয়। আমরা এই বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত দেখেছি আগের সরকারের আমলে—যেখানে সংসদ সদস্যদের কোনো ক্ষমতা ছিল না, সবকিছু কেন্দ্রীভূত ছিল দলপ্রধানের হাতে। এতে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। আরেকটি বাস্তব প্রশ্ন—গত কয়েকটি নির্বাচনে কেউই ৫০ শতাংশ ভোট পায়নি। এমনকি ৯১, ৯৬ বা ২০০১ সালে কেউ ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তাহলে শুধুমাত্র দলীয় ভোটে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠনই করতে পারবে না। সরকার গঠনই যদি না হয়, তাহলে দেশ চলবে কীভাবে?
এই দলগুলো বিষয়টি বোঝে। তারা জানে পূর্ণ পিআর বাস্তবসম্মত নয়। তবু তারা সেটার পেছনে ছুটছে শুধু তাদের ব্যর্থ জোট আলোচনা থেকে ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। আমাদের দীর্ঘ ১০–১৫ বছরের যে সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ—তার প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের এই নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। সেই অর্জনকে ছোট করে দেখানোর এই অপচেষ্টা অত্যন্ত দুঃখজনক।
আপনি সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে তরুণদের উজ্জীবিত করছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে, একজন মানুষ এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এখানে দুইভাবে দেখার বিষয় আছে। আপনি বলছেন, রাজনীতির বাইরের সম্পর্ক। গত কয়েক বছরে তারেক রহমানের সাথে আমার যে সম্পর্ক, পুরোটাই রাজনৈতিক সম্পর্ক। উনার নেতৃত্বেই আমরা একত্রিতভাবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম যেটাকে পরবর্তীতে আমরা এক দফা নাম দিই। এরপর থেকে আমরা একত্রিত আছি, কীভাবে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়বে। তাই, সেই জায়গা থেকে পরিচয়ের ভিত্তিটাই হলো রাজনীতি। আমাদের অনেক আলোচনা হয়, তবে প্রত্যেকটা আলোচনা রাজনীতির ভিত্তিতেই হয়। তবে গত কয়েক বছরে আমার সৌভাগ্য হয়েছে উনার সাথে অনেক আলোচনা করার, সেখান থেকে ব্যক্তিগতভাবে যদি আমি বলতে চাই, আমি দুটো জিনিসই বলব। আমার কাছে তারেক রহমান একজন সজ্জন ব্যক্তি, খুবই ওপেন মাইন্ডেড একটা মানুষ যিনি আসলেই বাংলাদেশকে ভালো কিছু দিতে চান, তারজন্য উনি নিজে কি চিন্তা করেন শুধু সেটা না, উনি সবার কাছ থেকে শুনতে চান, জানতে চান। আমার কাছে মনে হয় একজন লিডারের এটা অত্যন্ত মহৎ একটি গুণ।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিম্নমুখী এটা আমরা অবগত আছি। শিক্ষা ব্যবস্থায় আসলে সমস্যাটা কোথায় হয়েছিল? আর সমাধানটা কী সামনে?
সমস্যা তো আমরা অনেক জায়গায় অনেকভাবে আখ্যায়িত করতে পারি। তবে আমি সমাধানের দিকে যাই। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা খুবই খারাপ। এটা সমাধানের জন্য বা উন্নয়নের জন্য একটা-দুটো জিনিসের দিকে তাকালে হবে না। আমাদের ঢালাওভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে। এবং এটা লোকাল প্রয়োজনীয়তা ভালোভাবে বুঝে সাজাতে হবে। গত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান স্টাইলে সাজাতে চায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে। আমরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান না। লোকাল রিয়ালিটি অগ্রাহ্য করে আপনি যদি কিছু সাজাতে চেষ্টা করেন, সেটা কখনোই ভালো হতে পারে না। ওই জায়গা থেকে আমাদের লোকাল রিয়ালিটি বুঝে প্রাইমারি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা সব লেভেলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১ বছরের পারফরম্যান্স আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নম্বর দেওয়া খুব মুশকিল। আপনার সাথেই আলোচনা হয়েছিল যে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি ছিল। আক্ষরিক অর্থেই বেশি ছিল যেটা তারা পারার কথা না। এর থেকে আরও বেটার হওয়া উচিত ছিল। যেমন: তরুণ উপদেষ্টাদের নিয়ে আমি ইতোমধ্যে আপনার সাথে আলোচনা করেছি। এমনও ঘটনা ঘটছে যে তরুণ উপদেষ্টারা যে দলটা বানিয়েছেন, এনসপি, সরকারের পক্ষ থেকে এনসিপিকে বাহবা জানানো হচ্ছে। এই জিনিসগুলো সাধুবাদ জানানোর জিনিস না। এদিকে আবার সরকারের ভেতর থেকে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা আমরা দেখছি। উপদেষ্টার থেকে না এটা, সরকারের ভেতর বাকি আরও অনেকে আছে যারা এই অপচেষ্টা করছেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য এখনও এই সরকার কিছুই করেন নাই। অনেক কিছুই করতে পারেন নাই। সেটা তাদের দোষ না, হয়ত পারতেনও না। আবার অনেক জিনিস পারতেন, কিন্তু করেন নাই। আইন শৃঙ্খলা বা সামাজিক অবস্থা, আবার একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায় নিয়ে আসা, এটা অনেক কিছু পারেননি, অনেক কিছু করেননি। এভাবে অনেক তাদের দুর্বলতা আছে। আবার সব সরকারেরই দুর্বলতা থাকে। সে জায়গা থেকে কিছু বিষয় অবশ্যই ক্ষমার যোগ্য। তবে নির্বাচন প্রলম্বিত করলে এ ধরনের সমস্যাগুলো আরও ঘনীভূত হবে। তখন কিন্ত আমরা এই ব্যাপারগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবো না। তাই আপাতত আমি বলছি, যতদূর গেছে ঠিকঠাক গেছে, সামনে তাড়াতাড়ি নির্বাচন না হলে তাদের রেটিং আসলেই অবনতি ঘটবে।