
সাক্ষী হলো মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় মামলার বিচার কার্যক্রম। কিন্তু দেখা গেছে, বিভিন্ন মামলার অভিযোগপত্রে যাঁদের সাক্ষী করা হয় শুনানির সময় ওই সাক্ষীদের বেশির ভাগ অনুপস্থিত থাকেন। ফলে মামলার বিচার কার্যক্রমে বাড়ে দীর্ঘসূত্রতা। এতে তৈরি হয় মামলাজট।
সাড়ে চার বছর আগে ২০২০ সালের ৬ ডিসেম্বর খিলগাঁও থানায় মাদকদ্রব্য আইনে একটি মামলা করা হয়। তদন্ত শেষে ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
একইভাবে ২০২৩ সালের ৩ জুলাই পল্লবী থানায় একটি ডাকাতি মামলা করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ইশরাত হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিচারব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হলো সাক্ষ্য ও প্রমাণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের আদালতগুলোর বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। দেখা যাচ্ছে, আদালতে মাত্র ৩৩ শতাংশ সাক্ষী হাজির হচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘সাক্ষী সুরক্ষা আইন কার্যকর করা ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা, সরকারি সাক্ষী হাজির না হলে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সাক্ষ্যগ্রহণের ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। কিন্তু ডিজিটাল পদ্ধতিতে দ্রুত সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করা সম্ভব। এ ছাড়া সাক্ষীদের জন্য যথাযথ ভাতা ও নিরাপত্তা, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মোট ৪৮ হাজার ৮২৭ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির হতে সমন পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৩৮ হাজার ৬৪৯ জন পুলিশ সদস্য এবং ১০ হাজার ১১৭ জন সাধারণ নাগরিক। এর মধ্যে সমন পেয়ে আদালতে হাজির হয়েছেন ১৬ হাজার ৩৬০ জন। এই সাক্ষীদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ১৪ হাজার ৯৬৭ জন আর সাধারণ নাগরিক হলেন এক হাজার ৩৮৩ জন। অন্যদিকে আদালতে হাজির হয়েও সাক্ষ্য না দিয়ে ফিরে গেছেন ১৯৬ জন।
গত জানুয়ারি মাসে চার হাজার ৪৫৯ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন দুই হাজার ৩৫৫ জন পুলিশ সদস্য। অন্যরা সাধারণ নাগরিক। সমন পেয়ে ওই মাসে আদালতে হাজির হন তিন হাজার ৩৫১ জন সাক্ষী।
ওই মাসে আদালতে হাজির হলেও সাক্ষ্য না দিয়ে ফিরে গেছেন ৫৭ জন সাক্ষী।
ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ হাজার ৫১২ জন সাক্ষীকে সমন পাঠানো হয়। এর মধ্যে পুলিশ সদস্য আট হাজার ৩০৩ জন। ওই মাসে আদালতে হাজির হন তিন হাজার ৩৩৭ জন, যার মধ্যে তিন হাজার ৩৩ জন পুলিশ সদস্য আর ৩০৪ জন সাধারণ নাগরিক। আর আদালতে এসেও সাক্ষ্য না দিয়ে ফিরে গেছেন ৩২ জন।
মার্চ মাসে ১১ হাজার ৮৪২ সাক্ষীকে আদালতে হাজির হতে সমন পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৯ হাজার ৫৯৫ জন পুলিশ সদস্য। অন্যরা সাধারণ নাগরিক। সমন পেয়ে এই মাসে আদালতে হাজির হয়েছেন দুই হাজার ৭৬৫ জন। এর মধ্যে পুলিশ সদস্য দুই হাজার ৫২৭ জন এবং সাধারণ নাগরিক ২৩৮ জন। এ মাসে ২৯ জন সাক্ষ্য না দিয়ে ফিরে গেছেন।
এপ্রিল মাসে ১০ হাজার ৮৪১ জন সাক্ষীকে হাজির হতে সমন পাঠানো হয়। এর মধ্যে আট হাজার ৯৯২ জন পুলিশ সদস্য। অন্যরা সাধারণ নাগরিক। ওই মাসে মোট তিন হাজার ২৮৮ জন সাক্ষী আদালতে হাজির হন, যাঁদের মধ্যে তিন হাজার ৫০ জন পুলিশ সদস্য আর ২৩৮ জন সাধারণ নাগরিক। আর ৪৬ জন আদালতে এসেও সাক্ষ্য না দিয়ে ফিরে গেছেন।
মে মাসে ১১ হাজার ১৭৩ জন সাক্ষীকে সমন পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৪০৪ জন পুলিশ সদস্য। অন্যরা সাধারণ নাগরিক। সমন পেয়ে এ মাসে আদালতে হাজির হন তিন হাজার ৬১৯ জন। এর মধ্যে তিন হাজার ৩৪৫ জন পুলিশ সদস্য আর ২৭৪ জন সাধারণ নাগরিক। এ মাসে সাক্ষ্য না দিয়ে ফিরে গেছেন ৩২ জন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী সাদেকুর রহমান সোহাগ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক সময় সমন জারি করা হলেও সাক্ষীকে নিজ ঠিকানায় খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জন্য যেসব সাক্ষী সাধারণ নাগরিক তাঁদের বেশির ভাগ আদালতে হাজির হন না। তবে সমন পেয়েও পুলিশ সদস্যদের আদালতে হাজির না হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। এখানে পুলিশের যদি কোনো গাফিলতি থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। সাক্ষী হাজিরে সেল গঠন করে যথাযথ তদারকি দরকার।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক দিদার বলেন, ‘সাক্ষীদের হাজির করতে সেল গঠন করা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে সাক্ষীরা ভয়ে সাক্ষ্য দিতে আসতেন না। আশা করছি, এখন তাঁরা নির্ভয়ে আসবেন।’
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. তারেক জুবায়ের বলেন, ‘অনেক সময় সাক্ষীদের মধ্যে যাঁরা সাধারণ নাগরিক তাঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আর দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকেন পুলিশ সদস্যরা। বদলি বা অবসরে চলে গেলেও কিছুটা সমস্যা হয়। এ কারণে সমন জারির পরও সব সাক্ষী হাজির হন না। তবে সাক্ষীদের আদালতে হাজিরে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে।’