Image description

বাসভাড়া বাড়ানোর দাবিতে আবারও সরব হয়েছে পরিবহন মালিকদের একটি বড় অংশ। তারা বলছে, জ্বালানি তেল ও আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি, পরিচালন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি এবং সাম্প্রতিক বাজেটে নতুন কর সংযোজন—এই তিনটি বিষয় তাদের ব্যবসাকে গভীর সংকটে ফেলেছে। তবে এই দাবি এখনো আমলেই নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিআরটিএ বলছে, জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

তাই এটি আলোচনায়ও নেই। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মালিকদের অনেকে আন্দোলনের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। বিশৃঙ্খলা এড়াতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এখনই যৌথভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

গত ২২ জুন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণের আবেদন জানিয়েছে।

সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২২ সালের ৬ আগস্ট ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় শুধু ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ভিত্তিতে আন্ত জেলা ও দূরপাল্লার বাস ও মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২.২০ টাকা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া যথাক্রমে ২.৪০ টাকা ও ২.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ওই সময় গাড়ির টায়ার-টিউব, লুব্রিক্যান্ট, ব্রেকশু এবং অন্যান্য খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ট্রাক, পিকআপ, মিনিট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইমমুভারের (পণ্যবাহী পরিবহন) ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা না থাকায় এসব যানবাহনের ভাড়া সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা হয়নি।

সমিতির দাবি, ডলারের দাম এক বছরের ব্যবধানে ৮৪ টাকা থেকে ১২১ টাকায় উন্নীত হওয়ায় পরিবহন খাতে ব্যবহৃত আমদানি করা যন্ত্রাংশের দাম প্রায় দেড় গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে টায়ার-টিউব, লুব্রিক্যান্ট, ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি, ব্রেকশুসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। ফলে পরিবহন মালিকরা ব্যবসা পরিচালনায় ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের মুখে পড়ছেন।

চিঠিতে আরো বলা হয়, এ বিষয়ে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

জনগণের ক্ষতি করে সিদ্ধান্ত নয় : বিআরটিএ

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, ‘বাস মালিকদের কিছু দাবি যৌক্তিক হলেও ভাড়া বৃদ্ধির আগে আমাদের ভাবতে হবে জনগণের দিক থেকেও।

 
তেলের দাম বর্তমানে কিছুটা কমেছে, এমন সময়ে ভাড়া বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ তিনি জানান, ভাড়া পুনর্বিন্যাস নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ভাড়া বৃদ্ধির প্রশ্নই আসে না : যাত্রী কল্যাণ সমিতি

অন্যদিকে যাত্রীদের পক্ষ থেকে ভাড়া বৃদ্ধির বিরোধিতা এসেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকার বেশির ভাগ বাস এখনো মানহীন। যাত্রীসেবার ন্যূনতম মান বজায় নেই। ভাড়া বাড়ানোর আগে জরুরি এসব লক্কড়ঝক্কড় যান অপসারণ। দূরপাল্লার বাসগুলোর ক্ষেত্রেও অনেকে সেবার মান নিয়ে অভিযোগ করছেন। নতুন, আরামদায়ক বাস নামানো ছাড়া ভাড়া বৃদ্ধির প্রশ্নই আসে না।’

পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা

জানা গেছে, বর্তমান বাস মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছেন অনেক বাস মালিক। তাঁরা বর্তমান নেতৃত্বের কথা শুনছেন না। বাস পরিচালনা থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিজেদের মতো করে চালাচ্ছেন। মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বেশির ভাগ মালিক সমিতিকে সহায়তা করলেও গাবতলী অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আওয়ামী লীগ আমলের পরিবহন নেতারাই দূর থেকে টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাস মালিক বলছেন, দাবি আদায় না হলে গাড়ি চালানো সম্ভব হবে না। ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। এতে গণপরিবহন চলুক আর না চলুক। ব্যবসা করতে গিয়ে যদি লাভের জায়গায় লস দিতে হয় তাহলে কিভাবে চালিয়ে যাব।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়া বাড়ানোর যৌক্তিক দাবি আমরা জানিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর আমরা বিশ্বাস রাখি। আমাদের কথাও দায়িত্বশীলদের ভাবতে হবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি করা যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে মালিকদের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া বাজেটে নতুন ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, মালিকদের অর্থনৈতিক চাপ ও যাত্রীদের স্বার্থ—দুই দিক বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত সমন্বিত আলোচনা শুরু করা উচিত। পরিবহন খাতে স্বচ্ছ নীতিমালা, বাস্তবভিত্তিক ভাড়া কাঠামো এবং সেবার মান উন্নয়নের মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারলে সামনে আরো বড় সংকট দেখা দিতে পারে।