
সময় মাত্র আর ১৭ দিন। আগামী ৩০ অথবা ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ প্রস্তুত করতে চায়। গতকাল রবিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় ১২তম দিনের আলোচনার শুরুতে এই কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদে উপনীত হতে হবে; সেটা ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে যেকোনো প্রক্রিয়ায়। বড়জোর ৩১ জুলাইয়ে যেতে পারি।’ এ ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও এক জায়গায় আসার আহবান জানান।
গতকালের আলোচনার ফলাফলও ইতিবাচক। সরকার এককভাবে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবে না এবং জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ—এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে একমত হয়েছে দলগুলো। তবে এরপরও অনেকেই জানতে আগ্রহী রাষ্ট্রের সংস্কার প্রশ্নে চার্টার বা সনদ তৈরির ক্ষেত্রে গত পাঁচ মাসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কতটা সফল হলো? কাঙ্ক্ষিত ঐকমত্য কত দূর? কোন কোন মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হলো? কমিশনের কাজের অগ্রগতির ওপরই যেহেতু রাষ্ট্রের সংস্কার ও প্রত্যাশিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেকাংশে নির্ভর করছে, সে কারণে এখন এই কমিশনের সাফল্য-ব্যর্থতার প্রতি অনেকেরই মনোযোগ।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কতগুলো মৌলিক বিষয়ে এখনো দলগুলো একমত হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন—এগুলোসহ আরো কিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব এখনো ঐকমত্যের অপেক্ষায়। কমিশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আশা করছি আমরা সফল হব।
সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে প্রথম পর্বে গত ২০ মার্চ ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। এ আলোচনা চলে ১৯ মে পর্যন্ত। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি এমন ২০টির মতো বিষয়কে মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার প্রস্তাব হিসেবে চিহ্নিত করে ঐকমত্য কমিশন। সেগুলোর বিষয়ে ৩০টি দলকে একসঙ্গে নিয়ে গত ৩ জুন থেকে দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু হয়। গতকাল পর্যন্ত ১২তম দিনে ১৩টির মতো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
গতকালের আলোচনার শুরুতেই কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি জুলাই মাসের মধ্যে যেভাবে হোক একটি যৌক্তিক জায়গায় আসতে, যা হবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শহীদদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনের পদক্ষেপ।’
চলতি সপ্তাহে আলোচনা দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হবে বলে মনে করেন কমিশনের সহসভাপতি। জনগণ সংলাপ দেখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে জাতীয় সনদের জায়গায় পৌঁছাতে পারলে আমাদের দিক থেকে, আপনাদের দিক থেকে—সর্বোপরি নাগরিকদের থেকে সবাই নিঃসন্দেহে প্রত্যাশা করছেন আমরা খুব দ্রুততার সঙ্গে যেতে পারব।’
আলোচনা শেষে তিনি জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আজকের আলোচনায় জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ১৪১(ক)-এ সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিষয়গুলো হলো—অনুচ্ছেদ ১৪১(ক) সংশোধনের সময় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদন যুক্ত করতে হবে। আর জরুরি অবস্থা ঘোষণা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তাঁর অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া জরুরি অবস্থা চলাকালীন অনুচ্ছেদ ৪৭(ক)-এর বিধানসাপেক্ষে, কোনো নাগরিকের জীবনের অধিকার এবং বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে বিদ্যমান সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব করা যাবে না।
এর আগে গত ৭ জুলাইয়ের আলোচনায় অতীতে এই বিধান অপপ্রয়োগের বিষয় তুলে ধরে বিদ্যমান সংবিধানের ১৪১(ক) অনুচ্ছেদ সংশোধন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণা যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে সব কটি রাজনৈতিক দল এবং জোট একমত হয়েছিল।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল আরো বলেন, রাজনৈতিক দল এবং জোটসমূহ আজ প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৯৫-এ সুস্পষ্টভাবে কিছু বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে যুক্ত করতে হবে, ‘রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দান করবেন।’ অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে তবে তারা সংবিধানে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতির মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগদান করবেন—এমন বিধান সংযোজন করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের অভিযোগের কারণে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬-এর অধীন কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকলে তাঁকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদান করা যাবে না।
জরুরি অবস্থা জারির বিধান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে একমত হয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সীমাহীন ক্ষমতা কমিয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদি সিনিয়র মোস্ট দুর্নীতিগ্রস্ত বা জুডিশিয়ারির নানান সাজার দায়ে অভিযুক্ত থাকেন তাহলে দ্বিতীয়জন হবেন। এক না দুজনের মধ্যে এ বিষয়ে সমাধান না হওয়ায় কোনো রাজনৈতিক দল যদি জনগণের ভোটে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয় তবে জ্যেষ্ঠতম দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারবে।’ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় নিয়ে আগামীতে জাতীয় সংসদে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জরুরি অবস্থা জারিতে মন্ত্রিপরিষদ ও প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার মতামত নিতে হবে। এরপর অধ্যাদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি। এ বিষয়ে বেশির ভাগ দলই একমত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জামায়াত চায় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিই হবেন প্রধান বিচারপতি। যদিও কয়েকটি দলের মতামত দুই বা তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে বাছাই করা হবে। আমরা মনে করি, এতে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের ঢুকে পড়ার সুযোগ হয়ে যেতে পারে। অথবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিয়োগ হতে পারে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত একমত হওয়া যায়নি। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন না হলেও আমরা চাই এটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।’
এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য জাবেদ রাসিম বলেন, ‘আমরা জরুরি অবস্থাকে তিনটি ভাগ করতে বলেছিলাম; যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারি এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ গোলযোগের পরিবর্তে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বা ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্নে যদি জরুরি অবস্থা জারির মতো পরিস্থিতি দেখা দেয় সেই ক্ষেত্রে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবে। আগে যেমন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর অনুস্বাক্ষরে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারতেন, সেখানে এটি মন্ত্রিসভায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কলেবর একটু বর্ধিত করা হয়েছে। এ বিষয়ে এনসিপি একমত পোষণ করেছে।’
প্রধান বিরোধীদলীয় প্রধানের কথা জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্র মূল্যায়ন না করা হলে কী হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈঠক থেকে বের হয়ে বিরোধীদলীয় নেতা যদি জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন, তাহলে এর প্রভাব পড়বে।’ প্রধান বিচারপতির নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে জাবেদ রাসিম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্মে প্রবীণতম আপিল বিভাগের বিচারপতিকেই রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন। কিন্তু বৈঠকে কর্মে প্রবীণতম দুজন না একজন সেটা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। পরে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় কর্মে প্রবীণতমকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেবেন। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে জ্যেষ্ঠ দুজনের মধ্যে একজন সেটা সংবিধান সংশোধন করে করতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটা রূপরেখা এনসিপি দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বিচারাঙ্গনে নিয়ে আসার কারণে যে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে আমরা সেটার ঘোর বিরোধী।’
এ যাবৎ যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে : জরুরি অবস্থা ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়াও এ যাবৎ রাষ্ট্রের মৌলিক যেসব সংস্কার প্রস্তাব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো হলো—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন; এতে অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; এতে সরকারি হিসাব, অনুমিত হিসাব, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি—এই চারটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদ সংসদে আসনের সংখ্যানুপাতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ বিরোধী দলগুলো সংসদে যে কটি আসন পাবে, তার অনুপাতে সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ পাবে। নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ; এ বিষয়ে আশু এবং দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান; হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর।
যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি : আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি এমন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি (এনসিসির পরিবর্তে নতুন প্রস্তাব); বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এতে নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করার বিধান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতা কমানোর জন্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা—এই তিন অঙ্গের সমন্বয়ে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
কিন্তু বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এনসিসি গঠনের প্রস্তাবটি সংশোধন করে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে। এই কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, প্রধান বিরোধী দল ছাড়া অন্যান্য বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি, রাষ্ট্রপতির একজন প্রতিনিধি, প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। এই কমিটির দায়িত্ব হবে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য নাম চূড়ান্ত করা। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল ও তিন বাহিনীর প্রধান নিয়োগের বিষয়টি এই কমিটির দায়িত্বের বাইরে থাকবে।
জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশির ভাগ দল এই প্রস্তাবে নীতিগতভাবে একমত। তবে এই কমিটির বিষয়েও বিএনপিসহ কয়েকটি দলের জোরালো আপত্তি আছে। বিএনপি বলেছে, এ ধরনের কমিটি করা হলে সরকার দুর্বল হবে। ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট নিয়েও ঐকমত্য হয়নি। এ প্রস্তাবে বেশির ভাগ দলের আপত্তি আছে। বিএনপি ও জামায়াত মনে করে এই ব্যবস্থা এখনই বাস্তবায়ন করা কঠিন। ইসলামী আন্দোলন এর পক্ষে নয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও উচ্চকক্ষে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়েও ঐকমত্য হয়নি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে দলগুলোর বেশির ভাগ একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি ও ক্ষমতা নিয়ে মতভিন্নতা আছে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপিসহ কয়েকটি দল এর বিপক্ষে। তারা নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায়। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন নিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে একমত হতে পারেনি দলগুলো। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে একমত হলেও কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে এখনো একমত নয় দলগুলো। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল বা এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত সময় প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন—এ প্রস্তাব মানতে বিএনপির এখনো শর্ত রয়েছে। এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এ প্রস্তাবে সব দল একমত। তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির শর্ত হচ্ছে—সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি করা হবে না, এই শর্তে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকালের বিষয়টি মেনে নেবে। সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে দুটির সংশোধনীতে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বিদ্যমান চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র নিয়ে তেমন বিরোধ না থাকলেও অন্য দুটি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে ডান ও বাম দলগুলোর।
ডান দলগুলোর যুক্তি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে সংবিধানে এ দুটি মূলনীতি থাকতে পারে না। অথবা শব্দগত পরিবর্তন করতে হবে। অন্যদিকে বাম দলগুলোর অভিমত, এই চার মূলনীতির সঙ্গে প্রয়োজনে নতুন কিছু সংযুক্ত করতে তাদের আপত্তি নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে জড়িত ৭২-এর সংবিধানে হাত দেওয়ার সুযোগ নেই।
সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার মতো কিছু বিষয়ে এখনো আলোচনার অপেক্ষায়। সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হচ্ছে, সংসদ হবে দুই কক্ষের। সংবিধানের সব সংশোধনীর ক্ষেত্রে আলাদাভাবে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সংবিধানের প্রস্তাবনা, মূলনীতি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ইত্যাদি সংশোধন করতে উভয় কক্ষের পাশাপাশি গণভোটে পাস হতে হবে। এই প্রস্তাব এখনো আলোচনার অপেক্ষায়। তবে এতে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি রয়েছে। এ ছাড়া বিএনপি উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে। এ ছাড়া সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন কিভাবে হবে তা নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সংস্কার বিষয়টিকে সংসদের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। গত ৭ জুলাই ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের ১০তম দিনের আলোচনা শেষে তিনি এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের ম্যান্ডেট এই সরকারের হাতেই রয়েছে। আমরা যাঁরা ঐকমত্য কমিশনে বসছি, জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছি। সংস্কার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের অধিকার রয়েছে। ভবিষ্যৎ সংসদের কাছে এই কার্যভার ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতি আমরা নই।’