Image description
 

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে নরেন্দ্র মোদির যে একক আধিপত্য ছিল, তা এখন এক রূপান্তরকালীন চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০২৫ সালের শেষভাগে এসে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গন ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন প্রধান আলোচনার বিষয়— ‘নরেন্দ্র মোদি পরবর্তী ভারত কেমন হবে?’ আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে ভারতের এই ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

একক আধিপত্যের অবসান ও জোট রাজনীতির প্রভাব

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ভারতের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল। গত ১০ বছর মোদি যেভাবে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, বর্তমানে জোট সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা সেই ‘মোদি ম্যাজিক’কে কিছুটা সীমিত করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে মোদির উত্তরসূরি এবং তার পরবর্তী শাসনকাল নিয়ে খোদ দলের ভেতরেই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।

উত্তরসূরি নিয়ে বিজেপির অভ্যন্তরীণ সমীকরণ

প্রতিবেদনে বিজেপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে দুটি প্রধান ধারার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মোদির যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে মূলত দুই শক্তিশালী নেতার নাম আলোচনায় আসছে:

অমিত শাহ: মোদির দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সাংগঠনিক দক্ষতা ও হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে তিনি দলের ভেতরে অত্যন্ত প্রভাবশালী।

যোগী আদিত্যনাথ: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে পরিচিত। তৃণমূল পর্যায়ে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাকে নেতৃত্বের দৌড়ে সমান্তরাল অবস্থানে রেখেছে।

রয়টার্স বলছে, মোদি যদি কোনো কারণে দৃশ্যপট থেকে সরে যান, তবে এই দুই নেতার মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই বা সমঝোতা বিজেপির তথা ভারতের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে দেবে।

মোদি-পরবর্তী ভারতের তিন প্রধান চ্যালেঞ্জ

রয়টার্সের বিশ্লেষণে মোদি-পরবর্তী ভারতের জন্য তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে:

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বেকারত্ব: ভারতের প্রবৃদ্ধি দৃশ্যমান হলেও বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা পরবর্তী সরকারের জন্য প্রধান মাথাব্যথা হবে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।

২. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: গত এক দশকে ভারতের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন নেতৃত্বের সামনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।

৩. জোট রাজনীতির জটিলতা: একক প্রাধান্য কমে যাওয়ায় ভারতকে আবারও ১৯৯০-এর দশকের মতো সমঝোতার রাজনীতিতে ফিরতে হতে পারে। রয়টার্সের মতে, এটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করে দিতে পারে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ।

বিরোধী শিবিরের নতুন শক্তি

প্রতিবেদনে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে বিরোধী জোটের শক্তিশালী অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। গত এক দশকে ভারত প্রায় ‘বিরোধীশূন্য’ রাজনীতি দেখলেও এখন বিরোধী দলগুলো অনেক বেশি সংগঠিত। মোদি-পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস যদি এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে, তবে ভারতের রাজনীতিতে আবারও প্রকৃত দ্বিপাক্ষিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ ফিরে আসবে।

বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ

বিশ্বের বড় বিনিয়োগকারীরা মোদির অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে, এই সংস্কারগুলো কি টেকসই হবে? রয়টার্সের ভাষ্যমতে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের এই সন্ধিক্ষণে ভারত কি স্থিতিশীল থাকবে নাকি দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতার দিকে যাবে—তা নিয়ে বিনিয়োগ মহলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে।

উপসংহার: রয়টার্সের প্রতিবেদনটি এই বলে শেষ হয়েছে যে, নরেন্দ্র মোদি এখনই রাজনীতি থেকে বিদায় নিচ্ছেন না, তবে ‘পোস্ট-মোদি’ বা মোদি-পরবর্তী ভারতের চিত্রনাট্য লেখা শুরু হয়ে গেছে। ভারতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বজায় রাখতে এই রাজনৈতিক উত্তরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

সূত্র: রয়টার্স ব্রেকিংভিউস