Image description
 

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এখন এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে। একইসঙ্গে ভারতে তার অবস্থান দুই দেশের সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনাও তৈরি করেছে।

 

একদিকে ঢাকা তাকে ফেরত চাইছে, অন্যদিকে দিল্লির অস্বীকৃতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা ছিল যেমন কৌশলগতভাবে মূল্যবান, তেমনি ছিল রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণও। ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি ভারতের সবচেয়ে পছন্দের জিনিসগুলোই নিশ্চিত করেছিলেন। আর তা হচ্ছে— এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, যোগাযোগ বৃদ্ধি। এছাড়া হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ এমন এক প্রতিবেশী হিসেবে ছিল যে কিনা সবসময় নিজের স্বার্থকে ভারতের সঙ্গে মিলিয়ে নিত, চীনের সঙ্গে নয়।

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এখন শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন। কিন্তু এর মধ্যেই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ছাত্র আন্দোলন দমন-পীড়নের অভিযোগে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

 

মূলত ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। আর সেই আন্দোলনের পথ ধরেই নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। আগামী বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

এই পুরো ঘটনাপ্রবাহ এক জটিল কূটনৈতিক সমস্যা তৈরি করেছে। আর সেটি হচ্ছে- ঢাকা চায় হাসিনাকে ফেরত পাঠানো হোক, কিন্তু দিল্লি তাতে কোনও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যত কার্যকর করার মতো অবস্থা নেই।

যে আশ্রয় দিল্লি মানবিক সহায়তা হিসেবে দিতে চেয়েছিল, সেটিই এখন ভারতের জন্য পরিণত হয়েছে এক দীর্ঘ ও অস্বস্তিকর পরীক্ষায়। পুরোনো এক মিত্রের জন্য তারা কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে এবং এর জন্য কতটা কূটনৈতিক মূল্য তারা দিতে প্রস্তুত সেটিও বুঝতে চেষ্টা করছে ভারত।

দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারতের সামনে চারটি অস্বস্তিকর পথ রয়েছে। এক- হাসিনাকে ফেরত পাঠানো,তবে ভারত তা আদৌ করতে চাইবে না। দুই- বর্তমান অবস্থায় বজায় রাখা, কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে সেটা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিন- হাসিনাকে সম্পূর্ণ নীরব থাকতে চাপ দেয়া, কোনো বিবৃতি বা সাক্ষাৎকার না দিতে বলা। কিন্তু তিনি এখনও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাই এটা মানা হাসিনার পক্ষে কঠিন। এছাড়া দিল্লির পক্ষেও এমন কিছু চাপিয়ে দেয়া সমস্যাজনক। চার- হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর চেষ্টা, যদিও খুব কম দেশই এমন এক ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অতিথিকে’ নিতে চাইবে। কারণ হাসিনার বিরুদ্ধে গুরুতর আইনি অভিযোগ রয়েছে এবং তার বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন।

কুগেলম্যানের মতে, হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করা ভারতের জন্য অকল্পনীয়, কারণ ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক শিবির, সবাই তাকে ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখে। আর “ভারত কখনোই তার বন্ধুকে বিপদে ফেলে না”- এটাই ভারতের দীর্ঘদিনের নীতি।

আর চলমান এই মুহূর্তটা দিল্লির জন্য আরও অস্বস্তিকর কারণ ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের শিকড় অত্যন্ত গভীর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভারতের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। আর ভারত এখন এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। গত বছর দুই দেশের বাণিজ্য ছিল প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উভয় দেশের বাণিজ্যে বড় ঘাটতি রয়েছে এবং কাঁচামাল, জ্বালানি ও ট্রানজিট সুবিধায় ভারতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশ।

গত এক দশকে স্বল্পসুদে ভারত ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশকে। একইসঙ্গে কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, রেল যোগাযোগ তৈরি করেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ করছে। আর তাই এই সম্পর্ক থেকে সহজে কোনও পক্ষেরই সরে আসার সুযোগ নেই।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বলেন, পানি, বিদ্যুৎসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এতটাই গভীর যে ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে চলা কঠিন।

তবে অনেকে মনে করেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন করে গড়ে তুলছে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় রাজনীতিবিদ বিয়ান সাই জানিয়েছেন, নতুন সরকার যেন “ডি-ইন্ডিয়ানাইজেশন”-এর পথে চলছে, অর্থাৎ ভারতের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে।

এখন তারা বিচারবিষয়ক বিনিময় কর্মসূচি বাতিল করছে, ভারতের সঙ্গে জ্বালানি চুক্তির পুনর্বিন্যাস করছে, ভারতনির্ভর যোগাযোগ প্রকল্প ধীরগতির করছে এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বের জন্য প্রকাশ্যে চীন, পাকিস্তান, এমনকি তুরস্কের দিকেও ঝুঁকছে। আর এখান থেকে বার্তাটি স্পষ্ট। আর তা হচ্ছে- ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ আর আগের অবস্থানে নেই।

এ সম্পর্কের অবনতি জনমত জরিপেও দেখা যাচ্ছে। ঢাকার সেন্টার ফর অলটারনেটিভস-এর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা মাত্র ১১ শতাংশ। অনেকেই মনে করেন, ভারতের সমর্থনেই হাসিনা সরকার শেষ দিকে ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়েছিল। ফলে ভারতকে এখন অনেকের কাছে এক ধরনের আধিপত্যবাদী প্রতিবেশী মনে হয়।

অধ্যাপক ভরদ্বাজ জানান, রাজনৈতিক ওঠানামা থাকলেও অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সম্পর্ক সাধারণত টিকে থাকে। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ও দুই দেশের বাণিজ্য বেড়েছিল।

দিল্লির জন্য এখন মূল চ্যালেঞ্জ শুধু নির্বাসিত এক সাবেক মিত্রকে সামলানো নয়, বরং এমন এক প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিকঠাক বজায় রাখা যে দেশটি ভারতের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ— সবই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। দুই দেশের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। বিশাল এই সীমান্তের বেশিরভাগই অরক্ষিত ও নদী দিয়ে ঘেরা। আর তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন ভারতীয় সীমান্তে উদ্বেগ বাড়াতে পারে।

এসওএএস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবেনাশ পালিওয়াল মনে করেন, ভারতের এখন তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। ধীরে, নীরবে এবং সেনাবাহিনীসহ ঢাকার প্রধান রাজনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া দরকার। আর এই কূটনৈতিক পন্থা ভারতের জন্য সম্পর্ক মেরামতে কিছুটা সময়ও দেবে।

তার মতে, আগামী ১২-১৮ মাস দুই দেশের সম্পর্ক টালমাটাল থাকবে। বাংলাদেশে নির্বাচন কীভাবে হয় এবং পরবর্তী সরকার কী করে, তা দিয়ে নির্ধারিত হবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে।

যদি সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে পারে এবং স্থিতিশীলভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা নেয়, তবে দুই দেশ সম্পর্ক নতুনভাবে তৈরির চেষ্টা করতে পারে।

অবশ্য দিল্লির সামনে এখন শুধু কৌশলগত সিদ্ধান্তই নয়, আরও বড় একটি প্রশ্ন রয়েছে। আর তা হচ্ছে— কীভাবে তারা মিত্রদের আশ্বস্ত করবে যে ভারত সবসময় তাদের পাশে থাকবে, আবার একইসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত নেতাদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ থেকেও কিভাবে বাঁচবে দিল্লি?

পালিওয়াল প্রশ্ন তোলেন, এই দোটানায় ভারত পড়ল কেন? হাসিনার ওপর নির্ভর করে কি ভারত অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়েছিল?

সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘যে–ই ক্ষমতায় থাকবে, বন্ধুসুলভ হবে এবং ভারতের স্বার্থে কাজ করবে, ভারত তার সঙ্গেই কাজ করবে। পররাষ্ট্রনীতি জনমত বা নৈতিকতার ওপর চলে না, রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক খুব কম ক্ষেত্রেই তেমন হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই রাজনীতি অত্যন্ত বিভক্ত, সংঘাতপূর্ণ এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠাননির্ভর।’

ভারত এই গভীর রাজনৈতিক দূরত্ব কাটাতে পারবে কি না, তা এখন অনিশ্চিত। একইসঙ্গে অনেক কিছু নির্ভর করছে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারের ওপর। কুগেলম্যান বলেন, নতুন সরকার যদি ‘হাসিনা ইস্যু’কে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পথে দাঁড় করিয়ে দেয়, তাহলে এগোনো কঠিন হবে।

শেষ পর্যন্ত, নতুন সরকারকে সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও যোগাযোগের মতো দেশের মূল স্বার্থগুলোর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাব—এ সবের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে।

কুগেলম্যানের ভাষায়, ‘গুরুতর কোনো সংকটের আশঙ্কা আমি দেখি না, তবে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা নড়বড়ে হয়েই থাকবে।’