Image description
 

পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সংঘাত অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। গত কয়েকবছর ধরেই তেহেরিক-এ তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামের সন্ত্রাসী সংগঠনটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করছে আফগানিস্তান থেকে আসা-যাওয়া করে। ইসলামাবাদের এই অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি কাবুলের তালেবান সরকার।

 

কেন আফগান পাকিস্তান সংঘর্ষÑখুবই সহজসাধ্য ব্যবচ্ছেদ। সীমান্ত শরীরের এই জীবাণু অনুসন্ধানে বিশেষ ফরেন্সিক টেস্টের প্রয়োজন পড়ে না! আসলে তারা (তালেবান) ‘মার্সিনারি কিলার’। যে টাকা দেবে; তার পক্ষেই সে যুদ্ধ করবে। কাজেই আফগান-পাকিস্তান সীমান্তের যুদ্ধ পরিস্থিতিকে ছায়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে বুঝতে চেষ্টা করলে পরিস্থিতির একটা সুষ্পষ্ট ছবি হয়তো পাওয়া যাবে। যেহেতু তালেবান সরকারকে আরব বিশ্বের সরকারগুলোর মন জুগিয়েও চলতে হয়; তাই পাকিস্তান সীমান্তে এখনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে সে যেতে পারেনি। কিন্তু যে কোনো মুহূর্তেই যেতে পারে।

এই তো কিছুকাল আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার কাবুল সফর করে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। সেসময় সন্তোষজনক সিদ্ধান্ত হয় ইসলামাবাদ-কাবুল নিয়মিত যোগাযোগের।

কিন্তু এর পরপরই টিটিপি সীমান্তের পাকিস্তানি সেনা চৌকিতে হামলা চালালে; জবাবে পাকিস্তানের সেনা ও বিমান বাহিনী আফগানিস্তান সীমান্তের অভ্যন্তরে হামলা পরিচালনা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল টিটিপির ঘাঁটিগুলো। ফলে এই চ‚ড়ান্ত যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে হামলা ও প্রতিহামলায়।

চীন যেহেতু আফগানিস্তানের মূল্যবান খনিজ পাথর উত্তোলনে সহযোগিতা করছে; যা কাবুল সরকারের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি; সে কারণেই কাবুল-ইসলামাবাদ সমঝোতা তৈরির চেষ্টা করেছে। চীন যেহেতু বেলুচিস্তানের গাওয়াদার বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত; এর নিরাপত্তার স্বার্থে সন্ত্রাসী হামলা প্রশমন বেজিং-এর লক্ষ্য।

কিন্তু আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির দিলি­ সফরের সময়টিতেই কাকতালীয়ভাবে পাকিস্তান-আফগানিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়। আফগানিস্তানের অভ্যন্তর থেকে পাকিস্তানে ঢুকে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পেছনে ভারতের মদতের অভিযোগ ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছে। বেলুচিস্তানে সাম্প্রতিক ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনায় উন্নত সামরিক প্রযুক্তির ব্যবহার সন্ত্রাসীদের পেছনে কোনো রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীর প্রণোদনার ছাপ রেখে গেছে।

চাণক্য নীতির সুস্পষ্ট নির্দেশনা হচ্ছে, প্রতিবেশী শত্র“ রাজ্যের অপর পাশের রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সেখান থেকে প্রতিবেশী রাজ্যকে চাপসৃষ্টি।

ফলে দিলি­-কাবুল সম্পর্কের সাম্প্রতিক রসায়ন ইসলামাবাদের জন্য অশনি সংকেত। এখন তাকে পূর্ব সীমান্তে ভারত আর পশ্চিম সীমান্তে ছায়াভারতকে মোকাবিলা করতে হবে।

ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও অপারেশন সিন্দুর পরিচালনা করে আশানুরূপ ফলাফল পায়নি। আর ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত এতো সুরক্ষিত যে, সেখানে প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্ত এর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সুরক্ষিত করা কঠিন। আর সেখানে আফগানিস্তান থেকে হামলা পরিচালিত হলে পাকিস্তানি সেনা প্রহরা বাড়াতে ভারতের সঙ্গে পূর্ব সীমান্ত থেকে কিছু সেনা সেখানে নিয়ে যেতে হবে। এইভাবে উভয় সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাশক্তি বিভাজিত হলে ভারতের জন্য তাদের সেনা প্রধানের ভাষায় পাকিস্তানকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার কল্পনার অভিলাষ পূরণে আবার চেষ্টা করা সম্ভব। অন্তত পাকিস্তানকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ক্যাম্পেইনের ওপর ভর করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরবর্তী নির্বাচনি প্রচারণাকে তাপিত করা গেলেই বা ক্ষতি কি!

আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রচনায় পাকিস্তানের একটি দাদাগিরির প্রবণতা রয়েছে। তালিবানদের মুক্তিযুদ্ধে ইসলামাবাদের সহযোগিতা; যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে রাজি করানোতে পাকিস্তানের ভ‚মিকার কারণে ইসলামাবাদের মাঝে ‘লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির’ জাতীয় মনোভঙ্গি রয়েছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বনাম যুক্তরাষ্ট্র প্রক্সি যুদ্ধ ও পরে আফগানিস্তানে আমেরিকার আগ্রাসনের সময় বিপুল সংখ্যক আফগানকে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় দিয়েছিল পাকিস্তান। কাবুলের ক্ষমতায় তালেবানরা আসার পর পাকিস্তান জোর করে কিছু শরণার্থীকে আফগানিস্তানে ফেরত পাঠিয়েছে। পাকিস্তানে ২০ থেকে ৩০ বছরের শরণার্থী জীবনযাপনের পর আফগানরা সেখানেই একটা জীবন রচনা করেছিল। অনেক আফগান শিশুর জš§ হয়েছিল পাকিস্তানে; তাদের হুট করে আফগানিস্তানের অনিশ্চিত জীবনে ফেরত পাঠানো ছিল অমানবিক সিদ্ধান্ত।

আরেকটি দেশের ক্ষমতাসীনদের কোলে পিঠে করে লালন করতে যে সুমিষ্ট ভাষাটি লাগে; ভারতের তা জানা আছে। বাংলাদেশে সে এই সুমিষ্ট ছায়া উপনিবেশীর ভাষা অনুশীলন করেছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ ( ৫ আগস্ট)। বাংলাদেশে মনপছন্দ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে ভারতের কোলটি খালি ছিল। তাই আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে কোলে নিয়ে দিলি­ নতুন স্বপ্ন রচনা করেছে। আওয়ামী লীগ যেমন রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে ভারত মাতার কোমল বাহুডোরে ফুল খেলতো; তালেবানও তেমনি বিবেকানন্দ একাডেমিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালার প্রতি øেহের স্মৃতিচারণ করেছে আর দিেিত সেই কাবুলিওয়ালা গল্পের মিনিদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অজ্ঞাতে দুটো দেশে ছায়া উপনিবেশের প্রভাবক হয়ে উঠলেন যেন।

মোদি সরকার অতীতে সবসময় তালেবানদের সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করেছে; পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের সহযোগী হিসাবে অভিযুক্ত করেছে; ভারতের অভ্যন্তরে বসবাসকারী মুসলমানদের তালিবান তকমা দিয়ে তুচ্ছ করেছে। আবার চিরশত্র“ পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে সেই তালেবানকে দিলি­তে এনে তার ওপর পুষ্প বর্ষণ করেছে। স্টার প্লাস টিভি সোপের মতো মনোমুগ্ধকর এই ড্রামা-সাসপেন্স-শত্র“র শত্র“ আমার বন্ধু চিত্রনাট্য।

পাকিস্তানের জন্য এই আফগান সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি যেন নেমেসিস ছিল। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ যুদ্ধের ঠিকাদার হয়ে আবার তালিবানদের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করে যে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করেছে ইসলামাবাদ; তার প্রায়শ্চিত্য তাকে করতেই হবে। পাকিস্তানের সরকার সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনে আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে; যুদ্ধ শেষে মুজাহিদেরা বেকারত্ব ও হতাশায় সন্ত্রাসবাদী হয়ে পড়লে তাদের একটি অংশকে গোয়েন্দা সংস্থা ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক সরকারকে চাপে রাখার মারণ খেলায়। অবশেষে ২০১৪ সালে সন্ত্রাসবাদীরা পেশাওয়ার ক্যান্টনমেন্ট-পাবলিক স্কুলে হামলা চালিয়ে সেনা সদস্যদের সন্তানদের হত্যা করলে; তখন সন্ত্রাসবাদী নির্মূলে অ্যান্ড গেমে চলে গেছে। নেটফ্লিক্সের সাসপেন্স মুভির চেয়েও অনেক বেশি ক্লাইমেক্স এই মারণ খেলায়।

 

সুতরাং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার নিজ হাতে তৈরি ফ্রাংকেনস্টাইন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গিয়ে তাদের অ্যান্ড গেমে চলে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এই সন্ত্রাসবাদকে অনেকে গ্লোরিফাই করে জিহাদ ডেকে ইসলামি চেতনায় দোলা দিতো। এতদিনে তা হিন্দুত্ববাদীর হাতের খেলনা হয়ে প্রমাণ দিচ্ছে। 

পাকিস্তান সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মুসলিম বিশ্বের ন্যাটো গঠনের ডাক দিয়েছে। চীনকে গাওয়াদার বন্দর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়ে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে। আমেরিকাকে খায়বার পাখতুন খোয়া আর গিলগিট বেলুচিস্তানে পাওয়া রেয়ার আর্থ মিনেরেল উত্তোলনে প্রলুব্ধ করে; ভ‚রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা দখল করেছে। ভারতের অপারেশন সিন্দুরে পাকিস্তানের সামরিক সাফল্য একে অতি আÍবিশ্বাসী করেছে। সেই আÍবিশ্বাসের বেলুনের কিছু হাওয়া আফগান সীমান্ত লড়াইয়ে বের হয়ে যাওয়ায়; একটা ভারসাম্য তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। সীমান্তে চাপে থাকলে দেশটির অভ্যন্তরে এস্টাবলিশমেন্টের পঞ্চায়েতি কিছুটা কমে আসে।

এখন দেখার বিষয় ভারত তার সেই পাকিস্তানকে মানচিত্র থেকে মুছে দেয়ার খোয়াব আফগানিস্তানের ছায়া উপনিবেশে বসে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষের এই ৭৮ বছরের ঝগড়া যে দেশগুলোর অভ্যন্তরে সুশাসন দিতে অক্ষমতা ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা; এটা বুঝতে আর বাকি নেই। 

মাসকাওয়াথ আহসান, এডিটর ইন চিফ, ই-সাউথএশিয়া