Image description
 

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আট মাসের সংলাপের পর রাষ্ট্র সংস্কারে চূড়ান্ত হয়েছে জুলাই সনদ। এ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি প্রশ্ন ও এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। সনদ চূড়ান্তের পর মঙ্গলবার রাতে তা পাঠানো হয় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। আগামীকাল শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর এই সনদে স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে।

 

তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্যের কারণে শেষ মুহূর্তে সনদ স্বাক্ষরে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সে কারণে বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি পাঠিয়েছে, তাতে দেখা গেছে—৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অনেক বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। জুলাই জাতীয় সনদে সেগুলো যুক্ত করা হয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ।

তবে এই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে আলাদা করে কোনো সুপারিশের কথা উল্লেখ করা হয়নি জুলাই সনদে। যদিও জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়েই বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার।

সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে সেই ৪৭টি সিদ্ধান্ত, যেগুলো বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। পরের ভাগে রয়েছে ৩৭টি সিদ্ধান্ত, যেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।

তবে সব দল শেষ পর্যন্ত সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট করার বিষয়ে একমত হলেও ভোটের দিন ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতভিন্নতা আছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য বিবিসি বাংলাকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কিংবা পরবর্তী প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। যে কারণে বাস্তবায়নের সুপারিশ সনদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি।

কোন কোন প্রস্তাবে ঐকমত্য হয়েছে

কয়েক মাসের ধারাবাহিক সংলাপের পর গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই সনদের খসড়া পাঠিয়ে এ নিয়ে মতামত নেয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

পরে ১১ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত খসড়া পাঠানো হয় দলগুলোর কাছে। এরপর সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আরও দুই দফা সংলাপ করে ঐকমত্য কমিশন।

মঙ্গলবার রাতে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে চূড়ান্ত কপি পাঠিয়েছে, তাতে দেখা গেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে বেশিরভাগ দলই একমত হয়েছে। যেমন—

একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার বিষয়ে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সবাই একমত হয়েছে।

ডেপুটি স্পিকার ও বিরোধী দল করার বিষয়ে একমত বিএনপি ও জামায়াতসহ ৩১টি রাজনৈতিক দল ও জোট।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে একমত বিএনপি ও জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।

জাতীয় সংসদে অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পক্ষে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টি দল।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট ঐকমত্য পোষণ করেছে, যদিও ৯টি দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৯টি দল একমত।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার বিধানের বিষয়েও অধিকাংশ দল একমত।

জাতীয় সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব পর্যায়ক্রমে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ সব দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও স্বাধীন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি গঠনের বিষয়ে দলগুলোতে মতৈক্য হয়েছে।

গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কমিশন গঠনের প্রস্তাবেও ঐকমত্যে পৌঁছেছে ৩২টি দল।

ভিন্নমত আছে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে

এক ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না—এ প্রস্তাবে ২৫টি দল একমত হলেও বিএনপিসহ পাঁচটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।

সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিত করণের বিষয়ে ২৯টি দল একমত হলেও ভিন্নমত জানিয়েছে গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ তিনটি দল।

সংসদের সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতপার্থক্য থেকেই গেছে। পিআর পদ্ধতির পক্ষে জামায়াত, এনসিপিসহ ২৩টি দল; ভিন্নমত বিএনপিসহ সাতটি দলের।

সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা উল্লেখ থাকবে—যেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটি থাকবে না। এতে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৭টি দল একমত হলেও গণফোরাম, জেএসডিসহ কয়েকটি দল ভিন্নমত পোষণ করেছে।

ন্যায়পাল নিয়োগের প্রস্তাবে ২৫টি দল একমত হলেও পাঁচটি দল দ্বিমত পোষণ করেছে।

জুলাই সনদে স্বাক্ষরের পরবর্তী নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়নের বিষয়ে ২৭টি দল একমত হলেও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ভিন্নমত জানিয়েছে।

‘নোট অব ডিসেন্ট’-এ থাকা প্রস্তাবগুলোর কী হবে

আগস্টে খসড়া দেওয়ার সময়ই উল্লেখ করা হয়েছিল কোন কোন প্রস্তাবে ঐকমত্য বা ভিন্নমত রয়েছে। মঙ্গলবার পাঠানো চূড়ান্ত কপিতে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের সবগুলো যুক্ত করা হয়েছে এবং যেগুলোতে ভিন্নমত ছিল, সেগুলোর পাশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সংযুক্ত করা হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই জাতীয় সনদে যেহেতু কিছু ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে, তাই সেটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। ফলে চূড়ান্ত সনদে ভিন্নমতের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

জুলাই সনদে দেখা গেছে, পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি সংস্কার সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।

কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, যেসব দল কোনো প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে ওই সংস্কার মানতে বাধ্য থাকবে না।

সনদ স্বাক্ষরের পর বাস্তবায়ন কীভাবে

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি থাকবেন। প্রতিটি দল থেকে দুইজন প্রতিনিধি সই করবেন। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ দলগুলো ইতিমধ্যে প্রতিনিধির নাম কমিশনে পাঠিয়েছে।

শুক্রবার সনদ স্বাক্ষরের কথা থাকলেও বাস্তবায়ন প্রশ্নে মতপার্থক্যের কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে কমিশন বুধবার সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছে।

কমিশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগেই বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করলে কোনো কোনো দল সনদে সই করা থেকে বিরত থাকতে পারত। তাই বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

গণভোট কবে ও কীভাবে হবে

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় খুঁজতে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের কথাও জানানো হয়।

কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সব দল গণভোটে একমত হয়েছে।

তবে কবে, কীভাবে এবং কোন বিষয়গুলোতে গণভোট হবে, তা এখনো নির্ধারিত নয়। কমিশনের একজন সদস্য জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের পরামর্শে গণভোট আয়োজন করবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজনের সম্ভাবনা বিবেচনা করা হচ্ছে। যদিও সরকার এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করলে খরচ কিছুটা কমবে, তবে জনবল ও ভোটকক্ষ বাড়াতে হবে।

গণভোট ইস্যুতে বিএনপি চায়, জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হোক। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই গণভোটের পক্ষে।

 

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত গণভোট ইস্যুটি এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়েছে।