
একজন কৃষকের কাছে তিনটি ভিন্ন ধরনের পশু রয়েছে। তার মধ্যে তিনটি বাদে সবকটি ভেড়া। চারটি বাদে সব ছাগল এবং পাঁচটি বাদে সবই ঘোড়া। ওই কৃষকের কাছে কোন ধরনের পশু কটা করে রয়েছে?
যদি এই প্রশ্নটা পড়ে আপনার জটিল বলে মনে হয়, তাহলে বলে রাখা ভালো, আপনি একা নন। আপনার মতো অনেককেই এই প্রশ্ন দেখে চিন্তায় পড়তে পারেন।
এখন প্রশ্ন হলো কেন অঙ্ক কারো কারো কাছে কঠিন আর কারো কাছে একেবারে সহজ ঠেকে?
বিজ্ঞানীদের মতে এক্ষেত্রে জিন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে তা একটা বড় ধাঁধার ছোট্ট অংশ মাত্র। এর নেপথ্যে কারণটা জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের এক জটিল সংমিশ্রণ।
তবে অন্যান্য প্রশ্ন এবং তার উত্তর খুঁজতে যাওয়ার আগে বলে রাখা ভালো, ওই কৃষকের কাছে একটি ঘোড়া, দুটো ছাগল এবং তিনটি ভেড়া রয়েছে।
লন্ডনের গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউলিয়া কোভাস একজন জিনতত্ত্ববিদ এবং একইসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী যিনি ভিন্ন ভিন্ন মানুষের গণিত সমাধানের ক্ষমতা কেন আলাদা তা নিয়ে গবেষণা করেন।
জেনেটিক্স এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মতো কারণগুলো কীভাবে শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে তা বোঝার জন্য তিনি প্রায় ১০ হাজার আইডেন্টিকাল টুইনস (অভিন্ন যমজ) এবং নন-আইডেন্টিকাল টুইনস (বিষম যমজ)-এর ওপর এই গবেষণা করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, একটা নিষিক্ত ডিম্বাণু বিকশিত হয়ে দু'টো ভ্রূণে বিভক্ত হলে আইডেন্টিকাল টুইন বা অভিন্ন যমজ শিশুর জন্ম হয়। এক্ষেত্রে ওই যমজ শিশুর একই লিঙ্গ হয় এবং তাদের জিনগত উপাদান একই।
আবার যখন দুটো ডিম্বাণু দুটো ভিন্ন শুক্রাণু দ্বারা স্বাধীনভাবে নিষিক্ত হয়, তখন নন-আইডেন্টিকাল টুইন বা বিষম যমজ শিশু জন্মায়। তাদের লিঙ্গ এক নাও হতে পারে। তাদের জিনগত উপাদানের মধ্যে কিছুটা সামঞ্জস্য থাকে।
প্রফেসর কোভাস ব্যাখ্যা করেছেন, "নন-আইডেন্টিকাল যমজ শিশুদের চেয়ে আইডেন্টিকাল যমজ শিশুদের মধ্যে গুণগত সামঞ্জস্য বেশি। তাই গাণিতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও এই সাদৃশ্য দেখা গেছে। অর্থাৎ শুধু ঘরের পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে এই পার্থক্যকে বোঝা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে জিনেরও একটা অবদান রয়েছে বলে মনে হয়।"
তার মতে, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং যৌবনে গণিত শেখার এবং দক্ষতার ওপর জিনগত উপাদানের প্রভাব থাকে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।
ইউলিয়া কোভাসের কথায়, "এটা এই ধারণাকেই আরও মজবুত করে তোলে যে এক্ষেত্রে জিন এবং পরিবেশ দুইই গুরুত্বপূর্ণ।"

পরিবেশের গুরুত্ব
তবে এর পাশাপাশি আমরা যে পরিবেশে বাস করি, তাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আবার বিষয়টা এমন নয় যে আমাদের স্কুল কতটা ভালো বা হোমওয়ার্কের সময় কতটা সাহায্য মেলে তার ওপরই শুধু এটা নির্ভর করে।
প্রফেসর কোভাস জানিয়েছেন অনেক সময় কিছু 'কাকতালীয়' বিষয়ও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন রেডিওতে শোনা কিছু একটা যা আমাদের আগ্রহের দিশাকেই বদলে দিয়েছে।
তবে যে কোনো ব্যক্তির জিনগত প্রবণতা যে তাকে একটা বিশেষ ধরনের এক্সপোজার বা প্রতিক্রিয়া দেয়, তাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের লফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের গাণিতিক জ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা ড. ইরো জেনিডো-দারভো জানিয়েছেন, সবাই গণিতে বিশেষজ্ঞ না হলেও একটা ভালো খবর হলো মানুষ নিজের গাণিতিক দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে চিন্তাভাবনা, বিশ্বাস, মনোভাব এবং আবেগ আমাদের সংখ্যাগত জ্ঞান এবং গাণিতিক দক্ষতা বিকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ড. জেনিডো-দারভোর মতে, ম্যাথমেটিক্স অ্যাংজাইটি বা "গণিত নিয়ে উদ্বেগ" পারফরম্যান্সকে প্রভাবিত করতে পারে এবং এই বিষয়টা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যারা এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে উন্নতি করতে চায় যে তারা অঙ্ক পারবে।

ছবির উৎস,Getty Images
ম্যাথমেটিক্স অ্যাংজাইটি কী?
ড. জেনিডো-দারভোর মতে অঙ্ক করতে গিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা কিন্তু মানুষকে 'ভয় ও উদ্বেগের দুষ্টচক্রে'র মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে পারে। বিভিন্ন কারণে এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়ত বলেছে যে "আপনি অঙ্কে কাঁচা" বা অঙ্ক পরীক্ষায় আপনার সহপাঠীদের চেয়ে কম নম্বর পাচ্ছেন।
তার কথায়, "অঙ্ক নিয়ে ভয় আমাদের গণিত থেকে দূরে করে দেয়। এই দূরত্ব অঙ্কে দুর্বল পারফরম্যান্সের দিকে ঠেলে দেয় এবং দুর্বল পারফরম্যান্স 'গণিত নিয়ে উদ্বেগকে' বাড়িয়ে তোলে।"
এটা একটা চক্রের মতো।
আর ঠিক এইভাবেই এই বোঝা আমাদের ওয়ার্কিং মেমোরির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এখানেই কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া চলে।
ড. জেনিডো-দারভো বলেছেন, "যখন আমরা উদ্বিগ্ন থাকি তখন নেতিবাচক চিন্তা আমাদের এই মূল্যবান মানসিক জায়গার একটা বড় অংশ দখল করে ফেলে। এর ফলে বাস্তবে অঙ্ক নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য খুব একটা ক্ষমতা বাকি থাকে না।"
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি লফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। নয় থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে কাজের স্মৃতি এবং 'গণিত নিয়ে উদ্বেগ'র মধ্যে সম্পর্ককে খতিয়ে দেখা হয়েছিল ওই গবেষণায়।
গবেষণার সময় বাচ্চাদের দুই ডিজিটের অঙ্ক মনে মনে করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতিতে তার সমাধান করতে বলা হয় যখন তাদের কিছু শব্দ শুনতে এবং মনে রাখতে হতো।
ড. জেনিদো-দারভো ব্যাখ্যা করেছেন যে এই পরিস্থিতিতে "গণিত নিয়ে বেশি মাত্রায় উদ্বেগে" ভোগা শিশুদের পারফরম্যান্স কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

ছবির উৎস,Getty Images
সংখ্যা সম্পর্কে সহজাত বোধ
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ব্রায়ান বাটারওয়ার্থ কগনিটিভ নিউরোসাইকোলজি নিয়ে কাজ করেন।
তার গবেষণায় দেখা গেছে যে সংখ্যা বোধের ক্ষেত্রে মানুষের একজাতীয় বিল্ট-ইন বা জন্মগত ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা সেই সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যেও যারা কখনো গণনা করতেই শেখেনি।
তবে তিনি জানিয়েছেন যে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, এই "স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি খুব একটা ভালো কাজ করে না।"
শেখার ক্ষেত্রে একতা বড় সমস্যা হলো ডিসক্যালকুলিয়া। সংখ্যা এবং পরিমাণ বুঝতে এবং এই বিষয় নিয়ে কাজ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে এই সমস্যা।
প্রফেসর বাটারওয়ার্থের মতে, এই সমস্যা ডিসলেক্সিয়ার মতোই সাধারণ এবং প্রায় পাঁচ শতাংশ মানুষকে তা প্রভাবিত করে।
ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও সাধারণ অঙ্ক যেমন প্রশ্ন যেমন পাঁচ ও আটের গুণফল বা ১৬ ও ছয়ের যোগফল বের করতেও সমস্যা হয়।
প্রফেসর বাটারওয়ার্থ এবং তার টিম এমন একটা গেম ডিজাইন করেছেন যা বাচ্চাদের, বিশেষত ডিসক্যালকুলিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৌলিক গাণিতিক দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
তবে তিনি জানিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই জাতীয় উদ্যোগের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রফেসর বাটারওয়ার্থের কথায়, "এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ যে প্রাথমিক পর্যায়েই যাতে এই সমস্ত শিশুদের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা হয় এবং পরবর্তী কয়েক বছর তাদের বিকাশের ওপর নজর রাখা যায়।"
এই প্রসঙ্গে এটাও একটা প্রশ্ন যে কেন অঙ্ক অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে আলাদা।
অঙ্ক শেখাকে একটা "মানসিক ইটের পাঁচিলের" তৈরির সঙ্গে তুলনা করেছেন ড. জেনিডো-দারভো। এক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মজবুত ভিত্তি থাকাটা একেবারে অপরিহার্য।
"অঙ্কের ক্ষেত্রে এই ইটগুলোকে বাদ দিয়ে আপনি এগোতে পারবেন না। যেমন ইতিহাসের একটা যুগ সম্পর্কে আপনার অল্প জ্ঞান থাকলেও চলবে, কিন্তু অঙ্কের বিষয়ে এটা প্রযোজ্য না," বলেছেন তিনি।

ছবির উৎস,Getty Images
সারা বিশ্ব থেকে মেলা শিক্ষা
প্রফেসর ইউলিয়া কোভাস ২০০০ এর গোড়ার দিকে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে প্রোগ্রাম (আন্তর্জাতিক ছাত্র মূল্যায়ন জরিপ)-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ১৫ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের গণিত, পড়তে পারা এবং বিজ্ঞান বিষয়ে দক্ষতা পরিমাপ করা এবং বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন করা হয়।
প্রফেসর ইউলিয়া কোভাস বলেছেন, "এই জরিপের শীর্ষে ছিল চীনা শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে পূর্ব এশিয়ার আরও কয়েকটা দেশ ও ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীরাও ছিল। এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে থাকার কারণে এক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডকে 'ইউরোপীয় প্যারাডক্স' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।"
ভালো ফল করা এই দেশগুলোর কাছ থেকে কী আমরা কিছু শিখতে পারি?
চীনের জিয়াংসি নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের সহকারী অধ্যাপক ঝেনঝেন মিয়াও ব্যাখ্যা করেছেন যে চীনে গণিত শিক্ষা চারটি "মৌলিক" নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এগুলো হলো মৌলিক জ্ঞান, মৌলিক দক্ষতা, মৌলিক গাণিতিক অভিজ্ঞতা এবং মৌলিক গাণিতিক চিন্তাভাবনা।
ড. মিয়াও-এর মতে, চীনে শিক্ষক এবং শিক্ষাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়।
শিক্ষকদের প্রতিদিন কেবল একটা বা দু'টো ক্লাস নিতে হয়, যাতে তাদের কাছে পাঠ প্রস্তুত করা এবং তার পরিমার্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময় থাকে।
ফিনল্যান্ডের তুর্কু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক পেক্কা রেইসানেন জানিয়েছেন, ফিনল্যান্ডের গণিত শিক্ষা ব্যবস্থাও মৌলিক দক্ষতার বিষয়ে মনোযোগ দেয়।
তিনি বলেন, "ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল নীতি সর্বদাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মৌলিক দক্ষতার গ্যারান্টি দেওয়া।"
প্রফেসর রেইসানেন ব্যাখ্যা করেছেন যে ফিনল্যান্ডে শিক্ষক হওয়ার জন্য পাঁচ বছরের একাডেমিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।
এখানে এর জন্য উপলব্ধ আসনের চেয়ে দশ গুণ বেশি প্রার্থী আবেদন করেন। কারণ এখানে শিক্ষকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়।
তবে অধ্যাপক কোভাস এও জানিয়েছেন যে প্রতিটা দেশের ক্ষেত্রেই কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিছু বৈষম্যও রয়েছে যা এই "বিষয়টার জটিলতা"কেই দর্শায়।