
যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজা অভিমুখী প্রতীকী ত্রাণের বহর আবারো আটকে দিলো ইসরাইল। দখলদার বাহিনী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বহরের সঙ্গে আটক করেছে কয়েকশ’ অধিকার কর্মীকে। তাদের মধ্যে সুইডিশ অধিকার কর্মী গ্রেটা থুনবার্গও রয়েছেন। স্পেন থেকে যাত্রা করা গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা বৃহস্পতিবার গাজার কাছাকাছি আসার পর অভিযান শুরু করে ইসরাইলি কমান্ডোরা। তারা নানা কৌশলে বহরের জাহাজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ত্রাণের বহর আটকে দেয়ায় বিশ্ব জুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। বিক্ষোভ হচ্ছে দেশে দেশে। এ ঘটনার জেরে সবচেয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কলম্বিয়া। দেশটি থেকে ইসরাইলি সব কূটনীতিককে বহিষ্কার ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ফ্লোটিলা বহরে আছেন বাংলাদেশের অধিকার কর্মী প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। বহরের পেছনে থাকা একটি জাহাজ থেকে তিনি কয়েক দফা আপডেট দিয়েছেন দিনভর। তবে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই জাহাজের বিষয়ে আর কোনো তথ্য মিলেনি। ভিডিও পোস্টে তিনি জানিয়েছেন, বিকালে সমুদ্র ছিল উত্তাল। ঝড়ের দাপট কেটে গেছে। তিনি গাজায় পৌঁছানোর দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। গতকাল সারা বিশ্বে এই বিষয়টি ছিল টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড। অল্প সংখ্যক মিডিয়া বাদে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো মুহুর্মুহু সংবাদ আপডেট জানিয়ে যাচ্ছিল। অনেক মিডিয়া তাদের নিয়মিত সম্প্রচার বন্ধ করে গাজা ফ্লোটিলার রিপোর্ট অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকাশ করেছে।
রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, বহরে থাকা সুইডিশ পরিবেশ অধিকার কর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ বিভিন্ন দেশের অধিকারকর্মীদের আটক করেছে ইসরাইলের সেনারা। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার বিশ্ব জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুক্রবারও বেশ কয়েকটি দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়েছে স্থানীয় বেশ কিছু সংগঠন। ফ্লোটিলা বহরে থাকা নৌযান থেকে সরাসরি সমপ্রচারিত ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ইসরাইলি সৈন্যরা হেলমেট এবং নাইট ভিশন গগলস পরে জাহাজগুলোতে আরোহণ করছে, আর যাত্রীরা লাইফ জ্যাকেট পরে হাত তুলে জড়ো হয়ে আছেন। ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ফ্লোটিলার সবচেয়ে পরিচিত মুখ সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ সৈন্যদের ঘেরাটোপে জাহাজের ডেকে বসে আছেন।
এই অভিযানের আয়োজক গোষ্ঠী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলারের তথ্যানুসারে, ৪০টি নৌযানকে আটক করা হয়েছে। নতুন করে আরও দু’টি নৌযান যাত্রা শুরু করেছে বলে জানানো হয়েছে। তবে সেগুলোর একটিকে স্থির দেখা গেছে। আটককৃত নৌযান এবং যাত্রীদের প্রাথমিকভাবে ইসরাইলের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। একটি জাহাজকে ওই বন্দরে পৌঁছতেও দেখা গেছে বলে এক প্রত্যক্ষদর্শী রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছে।
ইসরাইলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্সের এক পোস্টে বলা হয়েছে, সকল যাত্রী নিরাপদ এবং সুস্থ আছেন। তাদের নিরাপদে ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখান থেকে তাদের ইউরোপে ফেরত পাঠানো হবে। তারা আরও যোগ করেছে, এখনো একটি জাহাজ সমুদ্রে ভাসছে। যেটি গাজার দিকেই রয়েছে। তেল আবিব জানিয়েছে, যদি এটি সক্রিয় যুদ্ধ অঞ্চলে প্রবেশ এবং অবরোধ লঙ্ঘনের চেষ্টা করে, তবে সেটিকেও প্রতিরোধ করা হবে।
এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইসরাইলের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়ে এটিকে গাজায় দুর্ভোগ লাঘবের লক্ষ্যে থাকা বৈশ্বিক সংহতি ও অনুভূতির বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, আন্তর্জাতিক জলসীমায় এভাবে কাউকে আটক করা বৈশ্বিক আইনের প্রতি ইসরাইলের ক্রমাগত লঙ্ঘনকেই জোরদার করেছে। এ ছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি এনকোসি জাওয়েলিভিলি ম্যান্ডেলাসহ ফ্লোটিলায় থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি করেছেন তিনি।
আদালতের শুনানির আগে ও ইসরাইলি কারাগারে থাকা অবস্থায় যাত্রীরা যেন আইনি সহায়তা পান, তা নিশ্চিত করাটা এখন প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন ইসরাইলের একটি মানবাধিকার সংস্থা ‘আদালাহ’। সংস্থাটির পরিচালক সুহাদ বিশারা বলেন, যাত্রীদের আশদোদ বন্দরে পৌঁছানোর পর অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং সেখান থেকে দেশে ফেরত পাঠানোর আগে তাদের দক্ষিণ ইসরাইলের কেটজিওট কারাগারে প্রেরণ করা হতে পারে।
আগস্টের শেষদিকে ইসরাইলি হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী গাজার জন্য ওষুধ ও খাদ্য নিয়ে আগস্টের শেষে যাত্রা শুরু করে সুমুদ ফ্লোটিলা বহর। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই অভিযানে মোট ৪৫টি বেসামরিক জাহাজ অংশ নিয়েছে। এতে আরোহী হয়েছেন ৫০০ যাত্রী। যার মধ্যে সংসদ সদস্য, আইনজীবী এবং সমাজকর্মীরা রয়েছেন। এটি গাজার উপর ইসরাইলি অবরোধের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষ প্রতিবাদ। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে সুমুদ ফ্লোটিলার যাত্রা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। যদিও এই বহর ঠেকাতে শুরু থেকেই তৎপরতা চালিয়েছে ইসরাইল।
নিজ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে নৌযান এবং ড্রোন পাঠিয়েছে তুরস্ক, স্পেন এবং ইতালি। ফ্লোটিলা বহর থেকে যাত্রীদের আটক করায় এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে তুরস্ক। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই আটককে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করেছে। এ ছাড়া ফ্লোটিলা থেকে দুই নাগরিককে গ্রেপ্তার করায় দেশ থেকে সকল ইসরাইলি কূটনীতিকদের বহিষ্কারাদেশ দিয়েছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো। পাশাপাশি ইসরাইলের সঙ্গে কলম্বিয়ার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও বাতিল করেছেন তিনি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমও ইসরাইলের নিন্দা জানিয়েছেন। দেশটির সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার ২৩ নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে তেল আবিবের বাহিনী।
ফ্লোটিলা বহর থেকে আটকের ঘটনা ইতালি ও কলম্বিয়ায় প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। এ ছাড়া গ্রিস, আয়ারল্যান্ড ও তুরস্কেও প্রতিবাদের ডাক দেয়া হয়েছে। এদিকে শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ইতালির শ্রমিক ইউনিয়নগুলো। ফ্লোটিলার এই অভিযানকে বরাবরই নাটক বলে নিন্দা জানিয়েছে ইসরাইল। ইতালিতে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত জোনাথন পেলেদ তার এক্স বার্তায় বলেন, সহায়তা হস্তান্তর করতে পদ্ধতিগত এই প্রত্যাখ্যান প্রমাণ করে যে, এই উদ্দেশ্য মানবিক নয়, বরং উস্কানিমূলক। নৌযানগুলো গাজা থেকে প্রায় ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকাকালীন সেগুলোকে আটক করা হয়। যা ইসরাইলি নজরদারি এরিয়ার মধ্যে ছিল বলে দাবি করা হয়েছে।