
কাতারের রাজধানী দোহায় ইসরাইলি বিমান হামলায় হামাসের পাঁচ সদস্যসহ ছয়জন নিহত হওয়ার পর উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) যৌথ প্রতিরক্ষা কাউন্সিল দোহায় জরুরি বৈঠক করে।
বৈঠক শেষে জিসিসি মহাসচিব জাসেম মোহাম্মদ আলবুদাইভি বলেন, কাতারের ওপর হামলা মানেই জিসিসির সব সদস্য দেশের ওপর হামলা। তিনি জানান, সদস্য রাষ্ট্রগুলো যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করবে, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বাড়াবে এবং আকাশসীমায় সমন্বয় জোরদার করবে। পাশাপাশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু ও যৌথ সামরিক মহড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জিসিসি কী
১৯৮১ সালে গঠিত গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের সদস্য রাষ্ট্র হলো—বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করাই এ জোটের মূল উদ্দেশ্য।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে জিসিসি দেশগুলো সম্মিলিতভাবে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১১৪.৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সৌদি আরবের ব্যয় সর্বোচ্চ—৬৯ বিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (২০.৭ বিলিয়ন), কাতার (৯.০২ বিলিয়ন), কুয়েত (৭.৭৭ বিলিয়ন), ওমান (৬.৫ বিলিয়ন) ও বাহরাইন (১.৪ বিলিয়ন)।
মার্কিন সামরিক উপস্থিতি
মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের তথ্যানুযায়ী, এ অঞ্চলে অন্তত ১৯টি স্থায়ী ও অস্থায়ী ঘাঁটি পরিচালনা করছে তারা। এর মধ্যে আটটি জিসিসি দেশের মধ্যে—বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হলো কাতারের আল উদেইদ এয়ারবেস, যা ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ১২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ ঘাঁটিতে ১০ হাজার মার্কিন সেনা এবং শতাধিক বিমান ও ড্রোন মোতায়েন রয়েছে। এটি মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) আঞ্চলিক সদর দপ্তর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
দোহায় হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কাতার সফর করেন। এ সময় কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি বলেন, আমরা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং এ ধরনের হামলা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।
এদিকে, গত সপ্তাহে সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এতে বলা হয়েছে, যেকোনো একটি দেশের ওপর আগ্রাসন হলে তা উভয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হবে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
সৌদি আরব
সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক রয়েছে সৌদি আরবের। তাদের হাতে আছে মার্কিন থাড, প্যাট্রিয়ট প্যাক-৩, আই-হক, ফরাসি ক্রোটেল, শাহিন, মিকা, মার্কিন স্টিংগার, অ্যাভেঞ্জার, ফরাসি মিস্ট্রাল এবং ইউরোপীয় কামান। এছাড়াও তারা একমাত্র জিসিসি দেশ যারা চীনের তৈরি সাইলেন্ট হান্টার লেজার সিস্টেম ব্যবহার করে ড্রোন প্রতিরক্ষায়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)
থাড ও প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের পাশাপাশি ইসরায়েলি বারাক সিস্টেম ব্যবহার করে। মাঝারি পাল্লায় দক্ষিণ কোরিয়ার চেওনগুং-২ এবং স্বল্প পাল্লায় ফরাসি ক্রোটেল, মিস্ট্রাল, রুশ ইগলা, পান্তসির-এস ১, সুইডিশ আরবিএস-৭০ ও ব্রিটিশ রেপিয়ার সিস্টেম রয়েছে।
কাতার: দূর ও মাঝারি পাল্লায় মার্কিন প্যাট্রিয়ট এবং নাসমাস-৩, স্বল্প পাল্লায় রুশ ইগলা, মার্কিন স্টিংগার, চীনা এফএন-৬ ও ফরাসি মিস্ট্রাল ব্যবহার করে। রয়েছে জার্মান গেপার্ড ও স্কাইনেক্স কামানও।
কুয়েত: দূরপাল্লায় প্যাট্রিয়ট প্যাক-৩, স্বল্প পাল্লায় ইতালীয় অ্যাস্পাইড, আর পয়েন্ট ডিফেন্সে স্টিংগার ও স্টারবার্স্ট মিসাইল রয়েছে। সঙ্গে জার্মান ওয়েরলিকন জিডিএফ কামান।
বাহরাইন: সম্প্রতি প্যাট্রিয়ট প্যাক-৩ এমএসই সিস্টেম সংগ্রহ করেছে। মাঝারি ও স্বল্প পাল্লায় তাদের ভরসা মার্কিন আই-হক ও ফরাসি ক্রোটেল সিস্টেম।
ওমান: অন্যদের তুলনায় উন্নত দূরপাল্লার সিস্টেম নেই। তবে স্বল্প পাল্লায় নরওয়েজিয়ান-মার্কিন, ফরাসি মিস্ট্রাল, মার্কিন জ্যাভলিন ও রুশ স্ট্রেলা-২ ব্যবহার করে। তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের কামানও রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, উপসাগরীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের বিভিন্ন প্রযুক্তি একত্রিত করে বহুপদক্ষেপে আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তবে কার্যকর সমন্বয় ও যৌথ প্রতিরক্ষা কৌশল বাস্তবায়নই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।