Image description

ভারতের বিহার রাজ্যে গত গ্রীষ্মে নির্বাচনকর্মীদের দেওয়া দায়িত্ব ছিল ভয়াবহ কঠিন। তাদের বলা হয়েছিল, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় আট কোটি যোগ্য ভোটারের পরিচয় যাচাই করতে। কাজটি নানা কারণে আরো জটিল হয়ে ওঠে। কারণ, তখন ছিল ফসল তোলার মৌসুম, সঙ্গে ভারী বন্যা। ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য বিহারের লাখো মানুষ কাজের খোঁজে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ছুটছিল। দেশের নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা নিয়েও দেখা দেয় বিভ্রান্তি, আর আইনি ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে কর্মীরা ভয়ংকর চাপের মুখে পড়েন।

এসব সমস্যার মধ্যেও কমিশন নির্ধারিত সময়ে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, ৬৫ লাখ মানুষের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের দাবি, এদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ মৃত; বাকিরা হয় স্থান পরিবর্তন করেছেন বা তাদের নাম দ্বৈতভাবে ছিল।

কিন্তু পরে দেখা গেল, যাদের মৃত দেখিয়ে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকেই জীবিত আছেন। বিরোধী দল এসব জীবিত মানুষকে রাজধানী নয়াদিল্লিতে নিয়ে আসে, প্রমাণ হিসেবে দেখায় যে পুরো যাচাই প্রক্রিয়াটি আসলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রভাবিত করার একটি চাল হতে পারে।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী মৃত হিসেবে তালিকাভুক্ত অর্ধডজন ভোটারকে রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করেছিলেনÑ‘শুনেছি আপনি নাকি বেঁচে নেই?’

রাহুল গান্ধী ও অন্যান্য বিরোধী নেতা তাড়াহুড়ো করা এই প্রক্রিয়াটিকে কেন্দ্র করে ভারতের ভোট প্রক্রিয়ার সুষ্ঠুতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, যেটি এতদিন ধরে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলÑযদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে।

১৩ কোটি মানুষের রাজ্য বিহারে গত বছর জাতীয় নির্বাচনে মোদির জোট থেকে দুই ডজনের বেশি এমপি নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমে মোদি তার তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পর রাজ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে সিদ্ধান্ত হবে বিহারের শাসনভার কার হাতে যাবে।

বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, ভোটার তালিকাকে হঠাৎ এবং এত বড় আকারে পরিবর্তন করার মানে হলো দুই নির্বাচনের একটিকে বিশ্বাস করা যাবে না। হয়তো গত জাতীয় নির্বাচনই সন্দেহজনক ভোটার তালিকার ভিত্তিতে হয়েছে, অথবা আসন্ন রাজ্য নির্বাচনে কিছু ভোটার বাদ দিয়ে শাসক দল ফলাফল প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

এর জন্য তারা মোদির দল বিজেপিকে অভিযুক্ত করছে। দলটি গত জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও জোটনেতা হিসেবে ক্ষমতায় রয়ে গেছে। এখন দলটি মুসলিম ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছে।

এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান ভোটারদের ওপর এতটাই বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে যে, বিশেষজ্ঞরা একে তুলনা করেছেন আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের ১৯০০-এর দশকের শুরুর সময়ের সঙ্গে, যখন কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সাক্ষরতা পরীক্ষা ও জটিল কাগজপত্রের অজুহাতে।

এই বিরোধ এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে এবং তা প্রবল রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ফলে এটি এখন পরিণত হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী বিশৃঙ্খলার বিষয়ে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচনকর্মী, ভোটার ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত নির্দেশনা মেনে সম্পন্ন হয়নি। এতে আরো নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকার আশা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।

নির্বাচন কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, বিরোধীদের উত্থাপিত লাখো অভিযোগ এবং সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের তীব্র সমালোচনা রয়েছে। তবে তাদের দাবি, প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যাচ্ছে এবং শিগগির শেষ হবে।

মোদির দল বিজেপি বিরোধীদের অভিযোগকে বাতিল করে দিয়ে বলেছে, এটি আসলে ‘পরাজিতদের ক্ষোভ’ ছাড়া কিছু নয়, তারা ভারতের গণতন্ত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। তারা এই ভোটার যাচাই প্রক্রিয়াকে জাতীয় পর্যায়ে ‘অনুপ্রবেশকারী’দের বের করে দেওয়ার অভিযানের সূচনা হিসেবে উপস্থাপন করছে।

বিরোধীদের অভিযোগ খণ্ডন করতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর বরং ভোট জালিয়াতি নিয়ে উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দেন। তিনি দাবি করেন, বিরোধীদের দ্বারা শাসিত পশ্চিমবঙ্গে ‘বাল্ক এডিশন’ বা ব্যাপক হারে ভোটার যোগ করা হয়েছে। এছাড়াও বিরোধী দলের জয়ী আসনগুলোতে কয়েক হাজার সন্দেহজনক ও দ্বৈত ভোটারের নাম রয়েছে।

অনুরাগ ঠাকুর বলেন, তারা তাদের অনুপ্রবেশকারীদের ভোটব্যাংক বাঁচাতে চাইছে।

রাহুল গান্ধী বলেছেন, তার জোটসঙ্গীরা কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফলে হতবাক হয়ে গেছেন, যেখানে জনমত জরিপে সমানে সমান থাকা সত্ত্বেও তারা হেরে যান। তারা প্রমাণ জড়ো করতে শুরু করেছেন, যা তাদের দাবি অনুযায়ী সাম্প্রতিক মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়। তবে নির্বাচন কমিশন তথ্য দিতে অস্বীকার করায় তারা নিজেদের উদ্যোগে প্রমাণ সংগ্রহ করছেন, যাতে ভোট দেওয়া মানুষের সংখ্যা আর রেকর্ডকৃত ভোটের সংখ্যা মেলানো যায়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা করে দাবি করেন, তাদের হয় শপথ করে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ তুলতে হবে, নয়তো ক্ষমা চাইতে হবে।

তিনি আরো মন্তব্য করেন, নির্বাচন কমিশন কি কারো মা, বোন, শাশুড়ির সিসিটিভি ভিডিও প্রকাশ করবে?

বিহারের এই বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রে রয়েছে কোন কোন নথি বৈধ পরিচয়পত্র হিসেবে গণ্য হবেÑতা নিয়ে।

নির্বাচন কমিশন রাজ্যের সব ভোটারকে একটি ফরম পূরণ করতে বলেছে এবং ১১টি নির্দিষ্ট নথির মধ্যে যে কোনো একটি জমা দিয়ে ভোটাধিকার প্রমাণ করতে বলেছে। কিন্তু তালিকায় বাদ দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে প্রচলিত পরিচয়পত্রগুলো, যেমন আধার কার্ড। আরো বিভ্রান্তিকর বিষয় হলো—অনুমোদিত নথির অনেকগুলোই আধার কার্ডের ভিত্তিতে ইস্যু করা হয়।

বিহারের সিভিল সোসাইটি সংগঠন দলিত বিকাশ অভিযান সমিতির নির্বাহী পরিচালক ধর্মেন্দ্র কুমার বলেন, আপনি বলেছিলেন সবকিছুর জন্যই আধার কার্ড দরকার। এটি নেওয়ার জন্য লোকদের লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। এখন কেন এটি ব্যবহার করছেন না?

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন কমিশনকে আধার কার্ডকে বৈধ পরিচয়পত্র হিসেবে যুক্ত করতে বললেও কমিশন বারবার গড়িমসি করেছে। অবশেষে তারা সম্মত হয়, তবে তখন নথি জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ার মূল অংশ শেষ হয়ে গেছে।

বিহারের অনেক নির্বাচনকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের শুরু থেকেই আধার কার্ড গ্রহণ করা ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ, শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে তালিকাভুক্ত অন্য কোনো নথি নেই।

কাজ শেষ করতে না পারলে সাময়িক বরখাস্ত বা বেতন কেটে নেওয়ার হুমকির মুখে কিছু নির্বাচনকর্মী ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। তারা ফ্যামিলি ট্রি বানিয়ে তার ছবি ব্যবহার করেন পরিচয়ের প্রমাণ হিসেবে। ধরে নেনÑযদি কারো বাবা বা মা আগের ভোটার তালিকায় থাকেন, তবে সেই ব্যক্তি ভোট দেওয়ার যোগ্য।

সমালোচকদের মতে, ভোটারদের জন্য তৈরি হয়েছে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি, আর কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতার অভাব পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; ফলে পরিষ্কার ও নির্ভুল ভোটার তালিকার আশা অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের দাবি, সাত কোটি ২০ লাখ ভোটারের মধ্যে ৯৮ শতাংশই আগস্টের শেষ নাগাদ তাদের নথি জমা দিয়েছেন।

বিহারের বিরোধী নেতা তেজস্বী যাদব বলেছেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী সংশোধিত খসড়া ভোটার তালিকা দেখে মনে হচ্ছে প্রতিটি আসনে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার ভোটারকে বাদ দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনভাবে করা মূল্যায়নগুলো দেখিয়েছে, গড়ে যে সংখ্যক ভোটার বাদ পড়েছেন, তা রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে গত নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীর ব্যবধানের চেয়ে বেশি।

সুপ্রিম কোর্ট কমিশনকে অভিযোগ সমাধান অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। যারা কাজের জন্য রাজ্যের বাইরে রয়েছেন বা ডিজিটাল শিক্ষা বা ইন্টারনেটের সুবিধা কম পেয়েছেন, তাদের পক্ষে নভেম্বরে রাজ্য ভোটের আগে এ বিষয়ে অভিযোগ করা সহজ কাজ হবে না।

পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার বলেছেন, তার স্ত্রীর নাম ভোটার তালিকা থেকে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বাদ পড়েছে। তিনি একজন নির্বাচনকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং আশা করছেন এটি ঠিক করা যাবে; কিন্তু তিনি অন্যদের জন্য চিন্তিত।

সঞ্জয় বলেন, শুধু সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির মানুষরাই ভুল সংশোধন করতে পারবেন।