
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ২০১০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ছিল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আস্তানা। এ সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি রক্তাক্ত সংঘর্ষের মঞ্চে পরিণত হয়। কখনো অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে গোলাগুলি, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ; আবার কখনো বিরোধী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর হামলে পড়ার ঘটনা ঘটত নিয়মিত। এ সময়ে শিবিরের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন নিজ দলের দুই নেতাকর্মীও। ছাত্রদলের কাউকে দেখলেই করা হতো মারধর। আর শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর করা হয়েছে অন্তত এক হাজারের বেশি ছাত্রকে।
বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের অন্তত পাঁচ নেতাকর্মীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এদের মধ্যে দুজন ছিলেন শিবিরের সদস্য, একজন সাথী, বাকি দুজন ছিলেন কর্মী। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলাকালে প্রতিপক্ষের গুলিতে সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাপস সরকার নিহত হন। এছাড়া ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকার নিজ বাসা থেকে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের একটি অংশকে দায়ী করে মামলাও করে দিয়াজের পরিবার।
জানা যায়, ২০১০ সালের ১১ মার্চ নৃশংস হত্যার শিকার হন শাখা ছাত্রশিবিরের কর্মী মহিউদ্দিন মাসুম। ষোলশহর রেলস্টেশনের কাছে তাকে হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। ২৮ মার্চ ছাত্রশিবিরকর্মী হারুন অর রশিদ কায়সার ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহরে যাচ্ছিলেন। চৌধুরীহাট স্টেশনে পৌঁছালে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয়।
শিবিরের অভিযোগ, এ দুটি হত্যায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ব্ল্যাক জুয়েল, আকতার, মো. রাকিব হাসান, মো. সাকিব, মহসিন কবির রিয়েল, মিরাজুল ইসলাম ও মজিবুর রহমান জড়িত ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট এলাকায় ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ছাত্রশিবিরের সাথী মুজাহিদুল ইসলাম। ওইদিন তাকে গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই দিন ছাত্রশিবির সদস্য মাসউদ বিন হাবিব ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। জিরো পয়েন্ট এলাকায় তাকে গুলি ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে তার মৃত্যু হয়।
শিবিরের অভিযোগ, এ দুটি ঘটনায় ছাত্রলীগের পীযূষ কান্তি বর্মণ, কাজী তানজিম হোসেন, আহসানুল করিম জনি, আশরাফুল ইসলাম আশা, আবুল মনসুর সিকদার, সুমন মামুনসহ আরো বেশ কজন জড়িত ছিল।
এরপর ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি ছাত্রশিবির সদস্য মামুন হোসাইনকে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে বলে অভিযোগ করেছে শিবির। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের মিজানুর রহমান বিপুল, মনসুর আলম, মামুন, আলমগীর টিপু, ফজলে রাব্বি সুজনসহ আরো কয়েকজন জড়িত ছিল বলে অভিযোগ করে সংগঠনটি।
থানায় মামলা হয়নি একটিও
এই পাঁচ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও থানায় কোনো মামলা নেয়নি পুলিশ। এছাড়া হাসিনা পালানোর আগ পর্যন্ত চবিতে প্রতিদিনই চলত শিবির সন্দেহে মারধর। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রমতে, ক্যাম্পাসে অন্তত এক হাজারের বেশি ছাত্রকে শিবির ট্যাগ দিয়ে মারধর করা হয়েছে।
হত্যার শিকার শিবিরের মামুন হোসাইনের দুলাভাই ১১ বছর পর মামলা করার প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আমার দেশকে বলেন, প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল আমার শ্যালক মামুন হোসাইনকে। সে সময় পুলিশ মামলা নেয়নি। উল্টো আমাদের চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল। এখন আমরা আইনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হাতে আমাদের পাঁচ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেককে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এসব ঘটনার কোনোটিতেই থানায় মামলা নেয়নি প্রশাসন। বরং উল্টো শিবির নেতাকর্মীদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এ সময় ছাত্রলীগ অন্তত ১৫ বার আমাদের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সংঘর্ষ ছাড়াও প্রায় নিয়মিতই শিবিরকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। শুধু শিবিরই নয়, সাধারণ শিক্ষার্থীরাও মারধরের শিকার হয়েছেন।
মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ছাত্রলীগ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। নিহতদের পরিবারগুলো এখনো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছে।
নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও ছাড়েনি ছাত্রলীগ
টেন্ডার ও গ্রুপিং রাজনীতির কারণে ‘হত্যার’ শিকার হন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর তিনি হত্যার শিকার হন বলে অভিযোগ পরিবারের।
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন মা জাহেদা চৌধুরী। ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচারের আশায় প্রহর গুনছেন দিয়াজের মা জাহেদা। তিনি বলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সন্তান হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য লড়ে যাব।
২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে খুন হন তাপস সরকার। এ ঘটনায় ১৭ ডিসেম্বর হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা করেন তাপসের সহপাঠী হাফিজুল ইসলাম। পিবিআই সূত্র জানায়, অভিযোগপত্রে ছাত্রলীগের সাবেক উপ-সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশাকে মূল খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ছাত্রদলও ছাড় পায়নি
আওয়ামী আমলে চবিতে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়নি। তবে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কাউকে পেলেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বেধড়ক মারধর করেছে। একাধিকবার মিছিলে হামলা করা হয়েছে, লাঞ্ছিত করা হয়েছে নেতাদের। অনেক ছাত্রদল নেতাকর্মীকে ক্যাম্পাসে পেয়ে আয়োজন করে মারধর করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়কে কলা অনুষদের সামনে মারধর করে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায় ছাত্রলীগ। ২০১৮ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগে চবি ছাত্রদলের যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক তালিমুলকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। একই সময় ছাত্রদলকর্মী আজিজ ক্লাসে গেলে তাকে ধরে নিয়ে প্রক্টর অফিস থেকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এ ছাড়া ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর চবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম শহীদসহ ১২ নেতাকর্মীকে মারধর করে ছাত্রলীগ।
ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, চবি ছাত্রদল সভাপতি আলাউদ্দিন মহসিন এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমানও ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন। তারা ছাড়াও ২০১২ সালের দিকে ছাত্রলীগের নিযার্তনের শিকার হয়েছেন তখনকার সভাপতি আমিনুল ইসলাম তৌহিদ, সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন সালাম মিঠু, সিনিয়র সহসভাপতি নেছারুল ইসলাম নাজমুল। এর পরের কমিটিতে সভাপতি হওয়া খোরশেদ আলম ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম শহীদও মার খেয়েছেন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে।
চবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন সালাম মিঠু বলেন, শেখ হাসিনা পালানোর আগ পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ একতরফাভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন; অথচ একটি হত্যারও বিচার হয়নি। ছাত্রলীগ আমাদের ছাত্রদল নেতাকর্মীদেরও টার্গেট করেছে। মিছিলে হামলা, লাঠিপেটা, হেনস্তাÑএসব নিয়মিত ঘটনা ছিল। কেবল ছাত্রদলের পরিচয় থাকলেই কেউ রেহাই পেত না।
আরেক সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম শহীদ বলেন, ছাত্রদলের ওপর ক্রমাগত দমন-পীড়ন চলেছে। আমরা যখন মিছিল করতাম, তখন হামলা হতো, পোস্টার ছিড়ে ফেলা হতো, নেতাদের মারধর করা হতো। এসব ঘটনায় প্রতিবারই আমরা থানায় অভিযোগ নিয়ে গেছি; কিন্তু প্রশাসন সাড়া দেয়নি। উল্টো আমাদেরই কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হয়েছে।
বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি বলেন, চবি ক্যাম্পাসে তখনকার সময় প্রশাসন ও পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে হয়তো সহিংসতা এভাবে বাড়ত না। আমরা ছাত্রলীগের মারধরের মধ্যেও ক্যাম্পাসে মিছিল-মিটিং করেছি।