Image description

একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে হামলা চালানো আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। প্রতিবেশী ইউক্রেনে হামলার কারণে পরাশক্তি রুশ ফেডারেশনকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নানান নিষেধাজ্ঞার জালে জড়িয়ে ফেলছে মানবিক মূল্যবোধের 'ধ্বজাধারী' দেশগুলো। কিন্তু, ইরানের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরায়েল যখন দেশটির ওপর হামলা চালায় তখন এর বিরোধিতা তো দূরের কথা চরম ধ্বংসাত্মক বোমা নিয়ে সেই হামলায় যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর মার্কিন-মিত্ররা দেয় নৈতিক সমর্থন।

শুধু ইরান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অপর খনিজসমৃদ্ধ ও আয়তনে তুলনামূলক ছোট কাতারের ওপর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে বিনা প্ররোচনায় ইসরায়েল যখন হামলা চালালো তখনও দেখা গেল একই দৃশ্য। আক্রান্ত পরও প্রতিবেশী দেশগুলো তো দূরের কথা 'বন্ধু' যুক্তরাষ্ট্রকেও পাশে পেল না কাতার।

কাতার মধ্যপ্রাচ্যে তথা মুসলিমবিশ্বে নিজের 'বিশাল ভাবমূর্তি' তৈরির জন্য বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করেছিল। দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে 'নিরপেক্ষ' হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান বিবদমান বিশ্বে কাতার নিজেকে 'মধ্যস্থতাকারী'র ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। তবুও আক্রান্ত এই শান্তিদূত।

নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে নিজ ভূমিতে ঘাঁটি করার অনুমতি দেয় কাতার। কিন্তু, এই দেশটির সার্বভৌমত্বকে তোয়াক্কা না করেই ইসরায়েল যখন হামলা চালালো তখন দেখা গেল সবাই 'চুপ'। অথচ মার্কিন ঘাঁটির পেছনে কাতারকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি কাতারে থাকা সত্ত্বেও বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেল না মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার বাসনাধারী এই দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিপদের সময় কাতারকে দেখা গেল 'বন্ধুহীন' অবস্থায়। এমনকি, আশ্চর্যজনক সত্য যে আরব দেশগুলোকেও পাশে পেল না দোহা।

ইসরায়েলি হামলার পর দোহার দৃশ্য। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি হামলার পর দোহার দৃশ্য। ছবি: এএফপি

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, কাতারে ঘাঁটি আছে যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশের। হামলার সময় তারা হাত গুটিয়ে ছিল বটে, হামলার পরও যেন কেউ কেউ মুখ খুলতেই নারাজ।

২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদ করে সৌদি আরব। সঙ্গে যোগ দেয় সৌদি-প্রভাবিত দেশগুলো। সেসময় কাতারকে একঘরে করার জন্য দেশটির আকাশ ও জলসীমা অবরুদ্ধের ব্যবস্থা হয়। সেসময় কাতারের পশ্চিমের মিত্রদের কাউকেই সামনে এসে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

২০২১ সালে আরব দেশগুলো দোহার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেও বাস্তবতা হচ্ছে গত ৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি হামলার সময় কাতারকে কেউ রক্ষা করতে আসেনি।

'গুরুত্বহীন' কাতার? 

গত ১১ সেপ্টেম্বর সংবাদমাধ্যম সিএনএন'র এক প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়—'প্রেসিডেনশিয়াল জেট ও বিশাল বিমানঘাঁটি ইসরায়েলের হামলা থেকে কাতারকে রক্ষা করল না। যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা বিষয়টির ওপর নজর রাখছে'।

কাতারের পক্ষ থেকে ইসরায়েলি হামলাকে 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে 'বিচারের মুখোমুখি' করার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। সার্বিক অবস্থা আমলে নিলে দেখা যাবে এসবের কোনকিছুই খুব একটা জোরালো নয়।

ট্রাম্পকে স্বাগত জানাচ্ছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
ট্রাম্পকে স্বাগত জানাচ্ছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, কাতারে ইসরায়েলি হামলা থেকে যে বার্তা পাওয়া গেল তা হলো ইসরায়েলি হামলা শুধু কাতারের সীমানাতেই আবদ্ধ থাকছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থিক ও রাজনৈতিক সুসম্পর্ক রাখা উপসাগরীয় দেশগুলোর মনেও এই সুসম্পর্কের সুবিধা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে।

অনেকের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে যে পুরোনো আস্থা ছিল, কাতারে ইসরায়েলি হামলায় তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, কাতার যদি গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে মধ্যস্থতা বন্ধ করে দেয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ সেই দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।

মিশর ও কাতার দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতা করে আসছে। ওমান সহায়তা করেছে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাষ্ট্র-হুতির মধ্যে মধ্যস্থতার কাজে। সংযুক্ত আরব আমিরাত কাজ করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দি বিনিময়ে। সৌদি আরব নিজেকে শান্তি আলোচনার 'পুণ্যভূমি' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

এসব দেশের নেতারা এখন অপেক্ষা করছেন কাতারের ওপর ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়। হামলার পাঁচ দিন পরও যখন এ নিয়ে তেমন জোরালো কিছু দেখা যাচ্ছে না তখন প্রশ্ন জাগে—কাতার নিজেকে যত বড় দাবিই করুক না কেন বাস্তবে দেশটি বিশ্বমঞ্চে তেমন 'গুরুত্বপূর্ণ' নয়?

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

শুধু কাতারে নয়, মধ্যপ্রাচ্য মার্কিন নিরাপত্তা বলয় কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা হারালো?—এমন প্রশ্নও জাগতে পারে কারো মনে।

হামলার পরদিন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান বিন জাসিম আল থানি আশা করছেন যে ইসরায়েলি হামলার 'সম্মিলিত জবাব' দেওয়া হোক। সিএনএনকে তিনি বলেন, 'পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল ঝুঁকিতে'।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব কতটা তাও উঠে আসতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভূমিকায়। গত মে মাসে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত মিলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তির বিষয়টিও সামনে চলে আসতে পারে।

ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের জানাজায় অংশ নিচ্ছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান বিন জাসিম আল থানি। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের জানাজায় অংশ নিচ্ছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুলরহমান বিন জাসিম আল থানি। ছবি: এএফপি

কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বদর আল-সাইফ সিএনএনকে বলেন, 'আমাদের এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। যদি আমরা তা না নিই তাহলে অন্য উপসাগরীয় দেশ আক্রান্ত হতে পারে।' 

গতকাল রোববার সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়—'উপসাগরীয় দেশগুলো কাতারে ইসরায়েলি হামলার জবাব দিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু, হাতে সুযোগ কম।'

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, কাতারে ইসরায়েলি হামলার আগে থেকেই তেল আবিবের প্রতি বিরক্ত আরব আমিরাত। দেশটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনে করেন ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে একীভূত করা হলে তা হবে 'আব্রাহাম চুক্তির মূল লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা'।

সবাই জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় 'আব্রাহাম চুক্তি'র মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়—কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে কাতার এমন ন্যক্কারজনক হামলার জবাব দিতে পারে।

আবার আসা যাক ইরান প্রসঙ্গে। গত ১৩ জুন ইসরায়েল যখন ইরানে হামলা শুরু করে তখন উপসাগরীয় দেশগুলোর অনেকে তাদের আকাশ তেল আবিবের জন্য খুলে দিয়েছিল। তারা কস্মিনকালেও ভাবতে পারেনি ভবিষ্যতে তারাও ইসরায়েলি হামলার শিকার হতে পারে। আর একবার যখন ইসরায়েল কোনো দেশে হামলা চালায় সেই দেশকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসে না। এমনটিই দেখা গেল লেবানন, সিরিয়া, ইরান ও কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর।

ঘনিষ্ঠরাও দূরে থাকে তখন।