
হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো ফের বলেছেন, রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল কিনে ভারত মস্কোর ইউক্রেন যুদ্ধকে অর্থ জোগাচ্ছে- এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ওয়াশিংটন যখন নয়াদিল্লিকে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কমাতে চাপে রাখছে, তখন তিনি এ মন্তব্য করেন।
সোমবার (১৮ আগস্ট) ফিনান্সিয়াল টাইমস-এ প্রকাশিত এক মতামত প্রবন্ধে নাভারো লিখেছেন, ভারত আসলে রাশিয়ার তেলের জন্য বৈশ্বিক ক্লিয়ারিংহাউস হিসেবে কাজ করছে। তারা নিষিদ্ধ অপরিশোধিত তেলকে উচ্চমূল্যের রপ্তানি পণ্যে রূপান্তর করছে এবং মস্কোকে ডলার দিচ্ছে, যা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে।
তিনি আরও বলেন, রাশিয়ান তেলের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা ''সুযোগসন্ধানী" এবং পুতিনের যুদ্ধ অর্থনীতিকে আলাদা করে রাখার বৈশ্বিক প্রচেষ্টার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
রাশিয়ান তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা ভারত (চীনের পরপরই), যার জ্বালানির ৩০ শতাংশেরও বেশি আসে মস্কো থেকে। এর ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ক্রেমলিন বিপুল রাজস্ব পাচ্ছে।
চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ইস্যুতে ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন, যা ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লি সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসে গত শুক্রবার (১৫ আগস্ট) এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দৃঢ় অবস্থান নেন। তিনি বলেন, উচ্চ শুল্কের মুখে ভারতের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি কোনো আপস করবেন না। তিনি ঘোষণা করেন, তিনি যেকোনো নীতির বিরুদ্ধে প্রাচীরের মতো দাঁড়াবেন যা কৃষকের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভারতের কৃষকদের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপস হবে না।
ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক
ভারত রাশিয়াকে তার ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সহযোগী হিসেবে দেখে। রাশিয়ার কাছ থেকেই ভারত বেশিরভাগ অস্ত্র কেনে, যার মধ্যে রয়েছে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেও নয়াদিল্লি ও মস্কোর সম্পর্ক সুসম্পর্কপূর্ণ রয়েছে, এবং মোদি সম্প্রতি পুতিনের সঙ্গে মস্কোতে বৈঠক করেছেন।
তবে গত কয়েক দশক ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করেছে। দুই দেশের বার্ষিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১২৮ বিলিয়ন ডলারের হলেও ট্রাম্প ক্রমাগত ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ওপর নির্ভর করছে চীনের উত্থানের মোকাবেলায়। কিন্তু সাম্প্রতিক মার্কিন নীতি ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। চলতি মাসের শেষে প্রধানমন্ত্রী মোদি চীন সফরে যাচ্ছেন, আর সোমবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই দুই দিনের সফরে ভারতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে আলোচনা করতে।
সোমবারের মতামত প্রবন্ধে নাভারো উল্লেখ করেন, ভারত রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হতে চায়, তবে তাকে সে অনুযায়ী আচরণ করতে হবে।
এছাড়া, ভারতের রাশিয়া ও চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করেন নাভারো। নাভারো হচ্ছেন ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা যিনি ভারতের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতিকে অর্থ জোগানোর অভিযোগ তুললেন। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে হোয়াইট হাউসের উপ-প্রধান স্টিফেন মিলার বলেছিলেন, ভারতের রাশিয়ান তেল কেনা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’।
ট্রাম্প খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ভারতের পক্ষে রাশিয়া থেকে তেল কিনে এই যুদ্ধকে অর্থায়ন করা গ্রহণযোগ্য নয়, ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন ট্রাম্পের প্রভাবশালী এই উপদেষ্টা।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশটিকে রাশিয়ান তেল কেনার জন্য ‘অন্যায়ভাবে’ আলাদা করে লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে, অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো রাশিয়া থেকে পণ্য কিনছে। নয়াদিল্লির যুক্তি হলো—যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। যদিও ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সেই বাণিজ্যে বড় ধস নেমেছে।
ইইউ’র হিসাবে, ২০২৪ সালে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭.৫ বিলিয়ন ইউরো (৭৭.৯ বিলিয়ন ডলার), যা ২০২১ সালে ছিল ২৫৭.৫ বিলিয়ন ইউরো (২৯৭.৪ বিলিয়ন ডলার)।
তাছাড়া, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইউরোপ এখনো রাশিয়া থেকে ১০৫.৬ বিলিয়ন ডলারের গ্যাস আমদানি করেছে—যা রাশিয়ার ২০২৪ সালের সামরিক বাজেটের প্রায় ৭৫ শতাংশের সমান, জানিয়েছে ফিনল্যান্ডের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫.২ বিলিয়ন ডলার, যদিও ২০২১ সালে তা ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে, কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, ভারত উচ্চ শুল্ক দিয়ে মার্কিন পণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অস্বীকার করছে।
আগস্টের ২৫ থেকে ২৯ তারিখে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের নয়াদিল্লি সফর করে এ বিষয়ে আলোচনার কথা থাকলেও তা বাতিল হয়েছে বলে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে একটি সূত্র জানিয়েছে। ফলে অতিরিক্ত মার্কিন শুল্ক থেকে ভারতীয় পণ্যকে মুক্তি দেওয়ার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত চুক্তি নিয়ে আলোচনাও পিছিয়ে গেল। সূত্র: আল জাজিরা
শীর্ষনিউজ