
জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত ‘আমাদের নতুন গৌরব গাঁথা’ প্রবন্ধে গণঅভ্যুত্থানের খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির কাজ সম্পর্কে খোঁজ রাখছেন এমন কয়েকজন শিক্ষাবিদ জানান, প্রবন্ধটিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব চিত্র আংশিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং গণহত্যার ইতিহাস থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ‘সুকৌশলে’ বাদ দেওয়া হয়েছে। এজন্য এ প্রবন্ধে একাধিক বিষয় সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবকারীরা মনে করছেন, এই প্রবন্ধ পড়ে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই বুঝতে পারবে না যে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান মূলত শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল। তাদের লিখিত অভিযোগ, প্রবন্ধে অপরাধী ও অনুঘটকদের ভূমিকা আড়াল করা হয়েছে, ফলে আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপট বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা কথা বলবেন।’ এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সদস্য প্রফেসর ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ের ‘আমাদের নতুন গৌরব গাঁথা’ প্রবন্ধের অসঙ্গতি সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন। প্রস্তাবকারীর মতে, এতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও বাস্তব চিত্র বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অপরাধী ও অনুঘটকদের নাম ও কার্যকলাপ চতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। গদ্যে ব্যবহৃত কিছু শব্দ পরিবর্তনেরও দাবি জানিয়েছেন প্রস্তাবকারী। যেমন—‘শাসক’, ‘দুর্বৃত্তবাহিনী’, ‘তার আছে দলীয় বাহিনী’ এবং ‘আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে যথাক্রমে ‘স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা’, ‘আওয়ামী লীগ’ এবং ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী’ ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অভিযোগকারী বলছেন, বিস্ময়কর মুন্সিয়ানায় রচনাটিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম সুকৌশলে গোপন করা হয়েছে। এই রচনা পড়ে একদমই বোঝার উপায় নেই যে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল ‘শতাব্দীর ঘৃণ্যতর ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার’ বিরুদ্ধে। অধিকন্তু এতে জুলাইয়ের খণ্ডিত চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষত ফ্যাসিবাদী সরকারের নৃশংসতা, মানুষের বিস্ময়কর বিস্ফোরণ ও অনন্য বৈপ্লবিক মুহূর্তের ঝাঁজ রচনাটিতে পুরোমাত্রায় অনুপস্থিত। এর সাহিত্যমানও যথেষ্ট লঘু।
পাঠ্যবইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ প্রত্যাহারের প্রস্তাবে এনসিটিবির ‘না’, সংক্ষেপন হচ্ছে
৮ম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে পূর্ণাঙ্গ ভাষণের পরিবর্তে সংক্ষেপিত রূপ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
সোমবার (১৮ আগস্ট) এনসিটিবি কার্যালয়ে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক অনুমোদন নিয়ে আয়োজিত সভায় বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। যদিও এর আগে ৮ম শ্রেণির বই থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালিত পুস্তক পর্যালোচনাকারী শ্রেণি শিক্ষকবৃন্দ।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৮ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে আগেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল। এটি সংক্ষিপ্ত আকারে রাখা হবে।’
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এনসিসির একাধিক সদস্য দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে সভায় নানা পর্যালোচনা হয়েছে। তবে একাধিক সদস্য এটিকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে বইয়ে রেখে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে তারা এটিকে সংক্ষিপ্ত আকারে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। ফলে ৭ মার্চের ভাষণ পাঠ্যবইয়ে থাকছে।’
বেশি পরিবর্তনের প্রস্তাব নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বইয়ে
এনসিসির একাধিক সদস্য জানান, ৮ম শ্রেণির বইয়ে ৭ মার্চের ভাষণ ছাড়াও হুমায়ুন আজাদ, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘মতো লেখকদের’ লেখা পর্যালোচনার অনুরোধ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য অংশের ‘রহমানের মা’ পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘রহমানের মা’ বাংলাদেশের ধর্মীয় অনুভূতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করে এমন কনটেন্ট দেওয়া যাবে না। গল্পটি স্পর্শকাতর। এখানে মুখের নিকাব খুলে ফেলার মধ্য দিয়ে শহীদ জননীর গৌরব ও ব্যক্তিত্বের অভিপ্রকাশকে প্রতিকায়িত করা হয়েছে। স্পষ্টতই এটি 'গৌরব' ও 'বোরখা'র মধ্যে এক ধরনের বিরোধ কল্পনা করে। গল্পটি এ-ও প্রস্তাব করে যে, নিকাব খুলে ফেলা ব্যতীত নারীর গৌরব ও আত্মসম্মান ধরা পড়ে না। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনাচরণে ও ধর্মবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। এর পরিবর্তে এ সংক্রান্ত অন্য গল্প যুক্ত করা যেতে পারে।
একই বইয়ের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ এই নাটকের চেয়ে সাবলীল শুদ্ধ ও রুচিশীল এবং ভাষাতাত্ত্বিক অনেক ভালো নাটক আছে সেগুলোকে এখানে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অশ্রাব্য এবং কটু ভাষা, বাক্যের জন্য এটাকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নাটকটির সংলাপে বেশ কিছু গালি ব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য এটি স্বভাবতই অস্বস্তি তৈরি করবে। উপরন্তু নাটকটি সাহিত্যিক মানদণ্ডে অদ্বিতীয় মূল্য ও তাৎপর্য বহন করে না বলে জানিয়েছেন প্রস্তাবকারী।