
রাজান আবু জাহের অনাহারে মারা যায়। সে ছিল মাত্র চার বছর বয়সী। একটি ধসে পড়া হাসপাতালের মেঝেতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগে করে সে। তার ছোট ছোট পাঁজর উঠানামা করতে পারছে না। অবস্থা এতটাই ভঙ্গুর যে নড়াচড়া করার মতোও শক্তি নেই। শরীরে আর কোনও চর্বিও অবশিষ্ট ছিল না। চোখ ঢুকে গিয়েছে ভেতরে। আর কণ্ঠস্বর- সে তো আরও অনেক আগেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
সে দ্রুত মারা যায়নি। ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। মারা যাওয়ার আগে তার মা তাকে ধরে রাখার কাকুতি মিনতি করেছিলেন। একজন ডাক্তার দেখেওছিল তাকে। কিন্তু তার কাছে ছিল না কোনও সিরিঞ্জ, আর না ছিল কোনও স্যালাইন। মুখে ছিল বলার মতো ছিল না কোনো ভাষা। অতঃপর মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় তাকে।
শিশু রাজানের মৃত্যু কোনও ট্র্যাজেডি ছিল না। এটি ছিল একটি দণ্ড, যা তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়নি, বরং লেখা হয়েছিল নীতিতে।
রাজান কেবল একা নয়। সে হাজার হাজারের মধ্যে একজন।
মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে, সম্পূর্ণ অবরোধের বেশ কিছুদিন পরেই, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তাকারী জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ গাজায় ৭৪ হাজারের অধিক শিশুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজারের অধিক শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। ৮ শতাধিক ইতোমধ্যেই সংকটাপন্ন।
খাদ্যকে হুমকি হিসেবে ঘোষণা করার পর কয়েক মাসের চিত্র এটি। আটা হয়ে গেছে নিষিদ্ধ পণ্য এবং দুধ পরিণত হয়েছে স্মৃতিতে। তাই এখন শিশুরা বাবা-মায়ের কোলেই মারা যায় অনাহারে।
মায়েরা এখন এমন শিশুদের কোলে করে রাখেন যারা আর কাঁদে না। বাবারা খালি হাতে কবর খুঁড়ে, ঘুমপাড়ানি গান ধুলোয় মিশে গেছে।
গাজা ক্ষুধা, মৃত্যু, আরব এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বাসঘাতকতায় ঘেরা। যারা বোমার আঘাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন তাদের মরতে হচ্ছে অনাহারে অথবা রোগে-শোকে।
অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ক্ষুধা এটি দুর্ভিক্ষ নয়। এটি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ক্ষুধা। দড়ি দিয়ে নয়, লাল ফিতা দিয়ে জনগণকে ইচ্ছাকৃতভাবে শ্বাসরোধ করা। কেবল বোমা দিয়ে নয়, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করা।
ইসরায়েল বেকারিতে বোমাবর্ষণ করে, সাহায্যকারী কনভয়গুলিতে গোলাবর্ষণ করে, খামারগুলিকে ধ্বংস করছে এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। গাজার বাসিন্দাদের হত্যা করতে তারা যে নির্ভুলতা ব্যবহার করে, সেই একই নির্ভুলতার সাথে তারা তাদের অনাহারে রেখেছে।
হ্যাঁ, ইতিহাস অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে জানে, কিন্তু গাজায় যা ঘটছে তা নজিরবিহীন। সাম্প্রতিক ইতিহাসে কখনও কোনও বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে বেড়া দিয়ে ঘেরা জমিতে আটকে রাখা হয়নি। যখন আকাশ, স্থল এবং সমুদ্র থেকে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে তখন তাদের খাদ্য, পানি এবং জ্বালানি থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে।
এটি অবরোধ নয়। এটি বিশ্বের প্রথম টেলিভিশনে প্রচারিত জাতিগত নির্মূল অভিযান। ক্রমাগত বিমান হামলার শিকার একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।
বসনিয়ায় ইচ্ছা ভঙ্গ করতে অনাহারকে ব্যবহার করা হয়েছিল। ওমরস্কা মৃত্যু শিবিরে ৬ হাজার বন্দীর মধ্যে ৭০০ জন ক্ষুধা এবং নির্যাতনের কারণে মারা গিয়েছিল।
স্রেব্রেনিকাতে, ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। একজন বসনিয়ান সার্ব সৈনিক স্বীকার করেন: ‘‘আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, স্রেব্রেনিকাতে অস্ত্র পাচারের বিষয়ে আমাদের চিন্তা করা উচিত নয়, বরং খাবারের বিষয়ে।’’
বসনিয়ার আগে, নাৎসি হাঙ্গার পরিকল্পনা ইহুদি এবং সোভিয়েত বেসামরিক নাগরিকদের নির্মূল করার চেষ্টা করেছিল। সাত মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল- সদৃশ হিসেবে নয়, বরং পরিকল্পনা অনুসারে।
সমাজবিজ্ঞানী মার্টিন শ' যেমন পর্যবেক্ষণ করে বলছেন, ইস্রায়েল নাৎসি গণহত্যার ধরণ অনুসরণ করছে। যেমনটা রাফায়েল লেমকিন তার ১৯৪৪ সালের বই অ্যাক্সিস রুল ইন অকুপাইড ইউরোপে বর্ণনা করেছেন।
এটি কেবল দেহের উপর আক্রমণ নয়। এটি চেতনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
ক্ষুধার্ত সাংবাদিক অনাহার কেবল হত্যার জন্য নয়, বরং চিন্তাভাবনা করার, সংগঠিত হওয়ার এবং আশা করার ক্ষমতাকে চূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি সাংবাদিকরাও ক্ষুধার্ত।
আল জাজিরার সংবাদদাতারা নিজেদের অভুক্ত থাকার কথা প্রচার করেছেন। তারা বলেছেন, ‘‘আমরা নিজেরা ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় আপনাদের কাছে খবর নিয়ে আসছি। গতকাল থেকে আমরা খাওয়ার জন্য একটি টুকরোও পাইনি।’’
তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পরিচালিত স্থানগুলিতে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) অনাহারে হত্যার ফাঁদে পরিণত হয়েছে। তারা এক বস্তা আটার আনার জন্য যায় আর ফিরে আসে মৃতদেহ হিসাবে।
রোববার ত্রাণপ্রত্যাশী ১১৫ জন ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ৯২ জন খাদ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছিল। এরমধ্যে উনিশ জন শিশুও ছিল।
২৭ মে থেকে জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলিতে ইসরায়েলি বাহিনী ক্ষুধার্ত বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালিয়ে আসছে। এতে হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় ৫ হাজার আহত হয়েছে।
একজন বাবা ক্ষীণকায় কাঁদতে কাঁদতে তার ছেলের রক্তাক্ত দেহ কোলে নিয়ে আটার জন্য অপেক্ষা করছিল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ভিডিওটি ধারণ করা হয়।
তিনি চিৎকার করেননি। তিনি কেবল ছেলেটিকে তার বাহুতে দোলাচ্ছিলেন। ওদিকে পিছন দিকে গুলি চলছিল। তার নাম ফিসফিসিয়ে বললেন- কারণ তার কাছে কেবল এটিই ছিল।
এটি মানবিক সংকট নয়। এটি ক্ষুধার মাধ্যমে ধ্বংস। এখনও বিশ্ব জোর দিয়ে বলে, এটি যুদ্ধ।
অপরাধী কারা? ইসরাইল বোমা ফেলে এবং দরজা সিল করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের জন্য অর্থ প্রদান করে এবং ভেটো দিয়ে এটিকে রক্ষা করে।
আসুন আমরা ইউরোপের কথা বলি। এর জ্ঞানার্জনের জন্য গর্বিত। তাদেরও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। মৃতদেহগুলো যখন ফিলিস্তিনিদের পড়ছে, তখন এভাবে নীরব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। তারা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, মানবাধিকার বাণিজ্যের একটি শর্ত। সেই প্রতিশ্রুতি এখন একটি কবর।
তাদের নিজস্ব পর্যালোচনায় ইসরায়েলকে লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর ইউরোপ কী করেছে? কিছুই না।
তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি ঢাকতে ইইউ দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের সাথে একটি মানবিক চুক্তিতে পৌঁছেছে। একটি অনুমিত অগ্রগতি। কিন্তু এটি নাটক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কোনও সাহায্য পাঠানো হয়নি। কোনও অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়নি।
এটি ছিল একটি ধোঁয়ার পর্দা- একটি অঙ্গভঙ্গি যা কেবল জনসাধারণকে অন্ধ করে দেওয়ার জন্য টানা হয়েছে। শিশুরা অনাহারে থাকা অবস্থায় সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে।
যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঘোষণা করেছে: ‘‘আইন, বিবেক এবং ইউরোপের প্রতি একটি নিষ্ঠুর এবং বেআইনি বিশ্বাসঘাতকতা।’’
এটি মনে রাখা হবে - নীতি হিসাবে নয়, বরং সহযোগিতা হিসাবে। নিরপেক্ষতা নয়, বরং অপরাধে অংশীদারিত্ব।
শুরু করুন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে দিয়ে। তিনি জেনারেল থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ইসরায়েল-সমর্থিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। তিনি কাঁদানে গ্যাস এবং কারাগার দিয়ে মিশর শাসন করেন। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্যভাবে সিনাইতে তিনি গাজাকে তালাবদ্ধ করতে একটি বাফার জোন তৈরি করেছেন।
রাফা ক্রসিং বন্ধ। সাহায্যের ট্রাকগুলি সূর্যের নীচে পড়ে থেকে থেকে পচে যায়। ডাক্তারদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শিশুরা মারা যাচ্ছে - সাহায্যের অভাবে নয়, বরং সাহায্য অবরুদ্ধ থাকার কারণে। আন্তর্জাতিক কর্মীদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্বাসন দেওয়া হচ্ছে।
ফিলিস্তিনি কেফিয়াহর এক ঝলক একটি অপরাধ। এটি নিরাপত্তা নয়। এটি দাসত্ব।
এরপরে জর্ডান রয়েছে। এটি এমন একটি দেশ যারা এক হাতে নিজের ঐতিহ্য বিক্রি করে, অন্য হাতে নিজ নাগরিকদের জেলে পাঠায়।
তারা শিক্ষক, ছাত্র, উপজাতি নেতাদের গ্রেপ্তার করে- ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়ানোর জন্য, তাঁবু ধরার জন্য, সাহায্যের আয়োজনের জন্য। তারা বলে, এটি তাদের মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে লড়াই।
এটি আসলে ফিলিস্তিনকে চূর্ণ করার জন্য। সিসি চেকপয়েন্ট দিয়ে যা করেন, জর্ডান আদালত কক্ষ দিয়ে তা করেন। সংহতি অপরাধে পরিণত হয়েছে। আত্মসমর্পণ একটি পুণ্য। এটি স্বৈরশাসকের নিয়মকানুন: পশ্চিমাদের আনুগত্য করো, ইসরায়েলকে আপন করে নাও। তারপর তোমার জনগণকে আটকে রাখো - এবং যা ইচ্ছা করো।
এরা (আরব শাসকরা) প্রত্যক্ষদর্শী নয়। তারা দুর্ভিক্ষে, অবরোধে, হত্যাকাণ্ডে অংশীদার।
বিশ্বের অসংযত লজ্জা এসব কিছুর মধ্য দিয়ে ধীর হত্যা, কূটনীতির নৃত্য - আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। আলোচনায় বিশ্বাস রাখতে। কিন্তু কোন ধরণের বিশ্ব ক্ষুধার্ত শিশুদের খাওয়ানোর বিষয়টি বিতর্কের বিষয় করে তোলে?
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে এটাই করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে- খাদ্যকে লিভারেজে পরিণত করা, অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর ত্রাণকে বিনিময়যোগ্য পুরস্কার হিসাবে বিবেচনা করা। এটি কেবল অনৈতিক ছিল না। এটি অবৈধ ছিল। এটি ছিল জঘন্য।
মানবিক প্রবেশাধিকার এটা কোনও অনুগ্রহ করার বিষয় নয়। এটি আইন দ্বারা আবদ্ধ একটি কর্তব্য। এটি বিলম্বিত করা, এটি নিয়ে বিতর্ক করা, রাজনৈতিক লাভের জন্য এটি আটকে রাখা মানে ক্ষুধাকে অস্ত্রে পরিণত করা এবং কূটনীতিকে যুদ্ধাপরাধের সহযোগীতে পরিণত করা।
গাজায় যা ঘটছে তা আইন লঙ্ঘনের চেয়েও বেশি কিছু- এটি আইনকে মুছে ফেলে। এটি মানবতার প্রতিটি নীতি, এটিকে সমর্থন করার দাবি করে এমন প্রতিটি চুক্তিকে ছিন্নভিন্ন করেছে।
বিশ্ব কেবল গাজাকে ব্যর্থ করেনি। এটি তাকে পরিত্যাগ করেছে। এবং এটি করার মাধ্যমে, নিজেকে উন্মোচিত করেছে।গাজা কেবল একটি হত্যাক্ষেত্র নয়। এটি একটি আয়না এবং এর প্রতিচ্ছবিতে আমরা আমাদের পরম, অসংযত লজ্জা দেখতে পাই।