
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে (ডিপিএইচই) কাজ করেন মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ। বর্তমানে কর্মরত কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে। তার চাকরি নবম গ্রেডে। এই পদে বৈধভাবে আয় করে কোনোরকমে তার সংসার চলে যাওয়ার কথা থাকলেও গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। এই জেলার আওয়ামী লীগ নেতা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের আশীর্বাদ পাওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নাসরুল্লাহকে। বদলি, পদোন্নতি ও প্রকল্পে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কামিয়েছেন প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা।
জানা গেছে, নাসরুল্লাহ আগে ছিলেন লক্ষ্মীপুরে। আওয়ামী মন্ত্রী তাজুলের আস্থাভাজন হওয়ার পর তার মাধ্যমে বদলি হয়ে আসেন কুমিল্লায়। আগে থেকেই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন এই প্রকৌশলী। বদলি হওয়ার পর হন আরো বেপরোয়া। ভুয়া ভাউচার, প্রকল্প থেকে কমিশন বাণিজ্য, কাজ না করেই ভুয়া ঠিকাদারের নামে বরাদ্দের পুরো টাকা আত্মসাৎসহ নানা কায়দায় হাতিয়েছেন রাষ্ট্রের সম্পদ। আর এসব কাজে তার কার্যালয়ের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারেন, এজন্য তাদের সঙ্গে অসদাচরণসহ নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। এরপরও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ গেছে। তবে অদৃশ্য কারণে হয়নি তদন্ত, পাননি কোনো শাস্তি।
ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের পক্ষে কুমিল্লা সদর উপজেলার এক ঠিকাদার গত ২ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কার্যালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদকে) নাসরুল্লাহর অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তিসহ লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও স্ত্রীর ব্যাংক স্টেটমেন্ট বিশ্লেষণ করলে ঠিকাদারদের সঙ্গে তার অস্বাভাবিক আর্থিক লেনদেনের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া ঘুষের টাকা দিয়ে নাসরুল্লাহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট, চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় পাঁচতলা বিলাসবহুল ভবন ও পূর্বাচলে ১০ কোটি টাকার প্লট কিনেছেন।
তার দপ্তরের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরে আট মাস ও লক্ষ্মীপুরে এক বছর তিন মাস দায়িত্ব পালন শেষে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রী তাজুলের উন্নয়ন সমন্বয়ক ও ডিপিএইচইর ঠিকাদার কামাল হোসেনকে ঘুষের বিনিময়ে নিজ জেলা কুমিল্লায় বদলি হন নাসরুল্লাহ। তাজুলের বিশ্বস্ত লোক হওয়ায় তাকে একদিনের নোটিসে কুমিল্লায় বদলি করা হয়েছিল।
অভিযোগে আরো বলা হয়, নাসরুল্লাহ যে বেতন পান, তার সব জমা করলে চাকরি জীবনের সঞ্চয় ৪০ লাখ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শুধু কুমিল্লায় আসার পর পাঁচ শতাধিক টেন্ডারের মাধ্যমে শতাধিক কোটি টাকার কমিশনবাণিজ্য করেন এই নির্বাহী প্রকৌশলী। এখান থেকে তিনি নিয়মিত কমিশন পাঠাতেন সাবেক মন্ত্রী তাজুলসহ দপ্তর-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তার কাছে।
ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্যের অভিযোগে বলা হয়, ২০২২ সালের ২৬ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের প্রিমিয়ার ব্যাংকের (কুমিল্লা ব্রাঞ্চ) অ্যাকাউন্ট থেকে নাসরুল্লাহর ইউনিয়ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে (আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চ) দুই লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ তার স্ত্রী সুরাইয়া সানজিদা চৌধুরীর মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের জুবলি ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টে আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শামীম ট্রেডার্সের দিদার ই আলমের ফরিদগঞ্জের এনআরবিসি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা পাঠানো হয়।
এতে আরো বলা হয়, ২০২২ সালের ১৯ মে মেসার্স শামীম ট্রেডার্সের দিদার ই আলমের এনআরবিসি ব্যাংক ফরিদগঞ্জের সাব-ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট থেকে নাসরুল্লাহর শ্যালক শাহিনুর জামান চৌধুরীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নিউ আদর কসমেটিকসের ব্যাংক এশিয়ার অ্যাকাউন্টে (চাক্তাই ব্রাঞ্চ) ৫০ লাখ টাকা পাঠানো হয়। একই তারিখে একই ব্রাঞ্চে শাহিনুর জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে দিদার ই আলমের ফরিদগঞ্জ এনআরবিসি ব্যাংক থেকে আরো ৫০ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়, ২০২২ সালের ২৬ জুন নাসরুল্লাহর আরেক শ্যালক মইনুল আরেফিন চৌধুরীর ইউনিয়ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টে রুদ্র কনস্ট্রাকশনের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ লাখ টাকা পাঠানো হয়। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর রুদ্র কনস্ট্রাকশনের প্রিমিয়ার ব্যাংক কুমিল্লা ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট থেকে তার বড় ভাই শহিদুল্লাহর ন্যাশনাল ব্যাংকের বরুড়া ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। একই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর বড় ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে আরো দুই লাখ টাকা পাঠানো হয় মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের প্রিমিয়ার ব্যাংকের কুমিল্লা ব্রাঞ্চ থেকে। একই বছরের ১৬ মে রুদ্র কনস্ট্রাকশনের অ্যাকাউন্ট থেকে আরো এক লাখ টাকা পাঠানো হয় নাসরুল্লাহর বড় ভাই শহিদুল্লাহর অ্যাকাউন্টে।
পরিবারের বাইরেও নিজস্ব ঠিকাদারের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও ঘুস লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে নাসরুল্লাহর বিরুদ্ধে। তার সময়ে সবচেয়ে বেশি কাজ ও অর্থনৈতিক লেনদেন হয়েছে মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে। এই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক শাহ মজিবের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন সময় লেনদেন করেছেন। শাহ মজিবের প্রিমিয়ার ব্যাংকের কুমিল্লা ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টে ঘুস নিয়ে পরে তিনি সেই টাকা ক্যাশ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে পাঠান বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের নথিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ৩ জুলাই লক্ষ্মীপুরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোহরাব ইসলামের এনআরবিসি ব্যাংক চন্দ্রগঞ্জ ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট থেকে মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের অ্যাকাউন্টে প্রায় ৯৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা লেনদেন হয়, যা পরে নাসরুল্লাহ ক্যাশ করে তার শ্যালক ও শ্যালকের প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা করেন।
এছাড়া আনিসুর রহমানের ইসলামী ব্যাংক চন্দ্রগঞ্জ ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রায় ২৩ লাখ টাকা, মেসার্স রহমান এন্টারপ্রাইজের ন্যাশনাল ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চ থেকে ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল তিন লক্ষাধিক টাকা, মেসার্স সোহরাব ইসলামের এনআরবিসি ব্যাংক চন্দ্রগঞ্জ ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২২ সালের ৩ জুলাই ১০ লাখ টাকা, ৩ অক্টোবর প্রায় ৫ লাখ টাকা, ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ৮ লাখ টাকা, ২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ১০ লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার অভিযোগ আছে। এ ছাড়া সিমেক ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেডের যমুনা ব্যাংক মালিবাগ ব্রাঞ্চের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রায় ১৭ লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভুয়া প্রকল্পবিষয়ক অভিযোগে বলা হয়, কুমিল্লার ২০২১-২২ অর্থবছরে পল্লী অঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্পের একটি কাজে কার্যাদেশ দেওয়ার চার দিনের মাথায় কোনো কাজ না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুদ্র কনস্ট্রাকশনের নামে চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করে সরকারের সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন নাসরুল্লাহ। একইসঙ্গে ওই প্রকল্পের আওতায় আরো চারটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং সেগুলো থেকেও সিএস বাবদ তিনি নিজ, প্রকল্প পরিচালক, প্রধান প্রকৌশলী, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ১০ শতাংশ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
হয়রানির শিকার হওয়ার শঙ্কায় নাম প্রকাশ না করে নাসরুল্লাহর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, নাসরুল্লাহর কয়েকটি বাড়ি আছে শুনেছি। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ মাঝেমধ্যেই ওঠে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী নাসরুল্লাহ বলেন, দুবছর ধরে এগুলো একটি চক্র বলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি দুদক তদন্ত করে ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দিয়েছে ।
চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ১০ কোটি টাকার প্লট কেনার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলো সব সত্য নয়। আমার নামে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।’
সাবেক মন্ত্রী তাজুলের মাধ্যমে একদিনে কুমিল্লা আসার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাজুলের সঙ্গে পরিচয় আছে। তবে আপনি আসুন, সরাসরি কথা বলব।’
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকৌশলী নাসরুল্লাহর অর্ধশত কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়। তখন মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে। কিন্তু নাসরুল্লাহ বর্তমান প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করায় সেই তদন্ত আর গতি পায়নি।