Image description
জমি প্লট ও ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) থেকে ক্রয় করা জমি বা ফ্ল্যাটের গ্রাহকদের লিজ দলিলের পরিবর্তে সাফ কবলা দলিল দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ উদ্যোগকে গ্রাহকরা স্বাগত জানালেও বাগড়া দিয়েছে জাগৃক। তারা বলছে, এ পদ্ধতি চালু হলে সম্পত্তির মালিকানায় জাগৃকের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। গ্রাহকের ক্রয় করা সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, হেবা বা বন্ধকে জাগৃকের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। এতে সংস্থাটির রাজস্ব কমবে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে পাওয়া নথি পর্যালোচনা ও বিভিন্নজনের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, নিজের কষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) থেকে জমি বা ফ্ল্যাট কিনছেন লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু সম্পত্তি কিনে পান না সম্পূর্ণ মালিকানা। সম্পত্তি নেওয়ার পর নানা নীতি ও দুর্নীতির বেড়াজালে পড়েন তারা। সম্পত্তি কিনে জিম্মি থাকেন জাগৃকের অসাধু কর্মচারীদের কাছে। এমনকি নিজের টাকায় কেনা সম্পত্তি ছেলেমেয়েকে দান বা বিক্রি ও ঋণ নিতে হলেও জাগৃকের দ্বারস্থ হতে হয়। আর এ সুযোগে দপ্তরটির পিয়ন থেকে শুরু করে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। অর্ধশতক থেকে চলে আসা লিজ দলিল নীতির বেড়াজাল থেকে সেবাগ্রহীতাদের মুক্তি ও দুর্নীতি কমাতে নতুন আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কিন্তু ভোগান্তি কমাতে নতুন উদ্যোগ নিলেও তাতে বাগড়া দিয়েছে জাগৃক।

সেবাগ্রহীতারা বলছেন, জাগৃকের ইট-বালুও যেন ঘুষের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। গৃহায়নের পিয়নও কোটি টাকার মালিক। নিজের অর্থ দিয়ে জমি কিনলেও সব ক্ষমতা থেকে যায় গৃহায়নের কাছে। উত্তরাধিকার যারা থাকে তাদের ওই সম্পত্তি লিখে দিতে হলেও যেতে হয় তাদের কাছে। পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। এতে যেমন প্রাইভেসি থাকে না; তেমনি বাড়তি ফি ও ঘুষ বাবদ বিপুল টাকা খরচ করতে হয়। তাই মন্ত্রণালয় লিজ দলিল বাদ দিয়ে ঝামেলাহীন ‘সাফ কবলা দলিল’ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে।

জাগৃক সূত্রে জানা গেছে, ‘বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার বিঘা জমি অধিগ্রহণ করলেও আদৌ সিটি জরিপ, নামজারি ও রেজিস্ট্রেশন নিজেদের নামে করতে পারেনি জাগৃক। তাই হরহামেশাই জমি বা ফ্ল্যাট বিক্রি বা লিজ দিলেও জাগৃক সাফ কবলা দলিল দিতে পারে না। তাই জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করে গেজেট জারি করে মালিকানা লাভ করে। জাগৃক শুধু লিজ দলিল করে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি রোধ ও সম্পত্তিতে নিজের বৈধতা দিতে লিজ দলিলের পরিবর্তে সাফ কবলা দলিল করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য আইনসহ ছয়টি বিষয় উল্লেখ করে জাগৃককে চিঠি দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। জনভোগান্তি কমাতে ইতিবাচক দিকগুলো ও নীতিমালার আলোকে কীভাবে মানুষের ক্রয় করা সম্পত্তির বৈধতা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এ চিঠি শুধু গৃহায়ন কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে এমন নয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আওতাভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, সাফ কবলার কথা শুনে সেবাগ্রহীতা বা সম্পত্তি গ্রহীতারা আশাবাদী হয়ে উঠলেও রীতিমতো যেন মাথায় বাজ পড়েছে জাগৃকের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। বিশেষ করে এ চিঠি পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে কর্মচারীরা। কারণ, বেশিরভাগ কর্মচারী অনিয়ম-দুর্নীতি ও ফাইল আটকে রেখে সেবাগ্রহীতাদের কাছে থেকে ঘুষ নিয়ে কাজ করে। গৃহায়নের প্রায় প্রত্যেক পিয়ন প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক। মূলত সেবাগ্রহীতাদের জিম্মি করে রেখেছে এ দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। চাকরি নেই; এমন প্রায় দুই ডজন লোক নিয়মিত অফিস করেন জাগৃকে। অফিসের ফাইল চালাচালি থেকে শুরু করে সবই করেন তারা।

মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি কমাতে ইতিবাচক উদ্যোগ নিলেও জাগৃক তাতে বাদ সেধেছে। আইনের ধারা উল্লেখ করাসহ সাফ কবলা দলিল দিলে জাগৃকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ খোদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও।

মন্ত্রণালয়ের চিঠির উত্তরে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, জাগৃক সৃষ্টির আগে কমিশনার পত্তনের সময়ও অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি একাধিক শর্তসাপেক্ষে বরাদ্দ দিয়ে আসছে। জাগৃক থেকে ৯৯ বছর মেয়াদি ইজারার মাধ্যমে লিজ দলিল দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান আইনে সাফ কবলা দলিলের মাধ্যমে প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের বিধান নেই। বর্তমান পর্যায়ে জাগৃকের এক কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির পক্ষে সংশ্লিষ্ট সাফ রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে বরাদ্দ প্রাপকের নামে লিজ দলিল রেজিস্ট্রির কার্যক্রম সম্পাদন করে থাকেন। জাগৃক কোনো ধরনের রেজিস্ট্রি দলিলমূলে জমির মালিকানা অর্জন করে না। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করে এবং গেজেট জারির মাধ্যমে জমির মালিকানা পায়। লিজের পরিবর্তে সাফ কবলা দলিলের বিক্রয় হলে পরবর্তী মালিকানা পরিবর্তনের ইজারা প্রদানকারীর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে হস্তান্তর কিংবা অন্য কারণে মালিকানা হস্তান্তরে প্রযোজ্য ফি পরিশোধ করারও প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ এতে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে। অধিগ্রহণকৃত জমির সাফ কবলা দলিল সম্পাদনে ভবিষ্যতে সরকারি প্রয়োজনে জমি ‘রিজিউম’ করার সুযোগ থাকবে না। সাফ কবলা দলিল গ্রহীতা একই সম্পত্তি অগোচরে একাধিক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর, বায়না, বন্ধক দিয়ে ‘প্রতারণা’ করতে পারে। লিজ দলিলের শর্তানুযায়ী লিজকৃত সম্পত্তি বিক্রয়, দান, হেবা, আম-মোক্তার দলিল সম্পাদন বা বন্ধকী ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে জাগৃকের পূর্বানুমতি নেওয়া আবশ্যক। একইভাবে নতুন ক্রেতারও বিক্রয়, দান, হেবা, আম-মোক্তার দলিল সম্পাদন বা বন্ধকী ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণ করার প্রয়োজন হবে না। এতে কাজের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হবে। সরকারের ভ্যাটসহ বিভিন্ন হারে ফি আদায় হবে না। এতে করে নতুন প্লট বা ফ্ল্যাট প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হবে। এ ছাড়া আয় কমে গেলে জাগৃকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ অসম্ভব হবে না।

এসব বিষয়ে গত ২০ জুলাই গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) আহ্বায়ক ও জাতীয় গৃহায়নকে (প্রশাসন ও অর্থ) সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বিদ্যমান আইন, বিধিমালা ও প্রবিধানমালা প্রয়োজনীয় সংশোধন বা সংযোজন অথবা পরিবর্তন বিষয়ে সুপারিশ করে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে সচিব বরাবর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাগৃকের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নুরুল বাসির কালবেলাকে বলেন, ‘জমির লিজ ও ফ্ল্যাট বরাদ্দের বিষয়ে মন্ত্রণালয় যেসব বিষয় জানতে চেয়েছিল জাগৃক, সেগুলোর জবাব দিয়েছে। সাধারণ মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে বিষয়ে নজর দেওয়া হচ্ছে।’

লিজ দলিলের পরিবর্তে সাফ কবলা দলিল করা হলে জাগৃকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে, চিঠিতে এ কথা উল্লেখ করার যৌক্তিকতা কতটুকু—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিঠিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে তার বিষয়ে মন্ত্রণালয় বুঝবে। আমাদের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।’

জাগৃকের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সদস্য এস এম সোহরাব হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘লিজ দলিল না করে সাফ কবলা দলিল কীভাবে করা যায়; আইনে কী আছে—এমন কিছু বিষয়ে মন্ত্রণালয় তথ্য জানতে চেয়েছিল। তার জবাব দেওয়া হয়েছে। আমাদের যেহেতু আইনে সাফ কবলা দলিলের বিধান নেই; তাই আইন পরিবর্তন হবে। এসব বিষয় নিয়ে মিটিং ও পর্যালোচনা চলছে।’