
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ‘ব্যাপক’ স্থলহামলা শুরু করেছ দখলদার ইসরাইল। গতকাল রোববার এ তথ্য জানিয়েছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। খবর আল জাজিরার।
তারা বলেছে, হামাসের বিরুদ্ধে বড় অভিযানের অংশ হিসেবে স্থলহামলা শুরু হয়েছে। আইডিএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘গতকাল, অপারেশন গিডিয়ন চ্যারটের অংশ হিসেবে আমাদের দক্ষিণ কমান্ডের স্যান্ডিং এবং রিজার্ভ সেনারা উত্তর-দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় ব্যাপক স্থলহামলা শুরু করেছে।’
প্রতিরক্ষা বাহিনী আরো জানিয়েছে, স্থলহামলায় সহযোগিতা ও হামাসের পাল্টা হামলা প্রতিহতে গত এক সপ্তাহে তাদের বিমানবাহিনী হামাসের ৬৭০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। যার মধ্যে ছিল হামাসের বিভিন্ন সেল, সুড়ঙ্গ এবং ট্যাংকবিধ্বংসী সাইট। এখন পর্যন্ত হামাসের কয়েক ডজন সদস্য এবং বেশ কিছু অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে বলেও দাবি করেছে তারা। এ ছাড়া গাজার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো দখল করে রাখার তথ্য জানিয়েছে দখলদারদের প্রতিরক্ষা বাহিনী।
অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইসরাইলিদের রক্ষায় এই হামলা প্রয়োজন অনুযায়ী অব্যাহত থাকবে এবং বিমানবাহিনী এতে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী।
গত এক সপ্তাহে ইসরাইলিদের বিমান হামলায় গাজায় পাঁচশর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। দখলদার ইসরইল হামাসের সদস্যদের হত্যার দাবি করলেও তাদের হামলায় নিহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। শুধুমাত্র গতকাল রোববার গাজায় অন্তত ১৩৫ জনকে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনারা।
ইসরাইলিদের হামলার কারণে গাজার উত্তরাঞ্চলের সব হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে করে আহত মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন।
ইসরাইলিদের এ বর্বরতা বন্ধে কাতারের রাজধানী দোহায় মধ্যস্থতাকারীদের সাথে হামাসের আলোচনা চলছে। গতকালও সেখানে যুদ্ধবিরতি নিয়ে কথা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এ আলোচনা সফলতার মুখ দেখেনি। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে হামাসের এক কর্মকর্তা বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘ইসরাইলের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। তারা যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে জিম্মিদের মুক্ত করতে চায়। কিন্তু আমরা বলেছি গাজা থেকে ইসরাইলের সব সেনাকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে, গাজার অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে তাহলে তাদের সব জিম্মিকে আমরা একসাথে মুক্তি দেবো।’
গাজায় ইসরাইলি হামলায় ১ দিনেই নিহত ১৩৫ : যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নতুন দফায় মধ্যস্থতা শুরু হয়েছে শনিবার থেকে। তবে আলোচনার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো রয়টার্সকে জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। স্কাই নিউজ আরাবিয়া ও বিবিসি জানিয়েছে, হামাস একটি প্রস্তাব দিয়েছে- যার আওতায় তারা দুই মাসের যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ইসরাইলি বন্দীদের প্রায় অর্ধেককে মুক্তি দিতে চায় এবং এর বদলে ইসরাইলি কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনিদের ছাড়ার দাবি জানিয়েছে।
রয়টার্সকে হামাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ইসরাইলের অবস্থান অপরিবর্তিত- তারা শুধু নিজেদের বন্দীদের মুক্তি চায়, যুদ্ধ শেষের কোনো প্রতিশ্রুতি ছাড়াই। এমন অবস্থায় যুদ্ধবিরতিতে নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে হামাস নেতা মোহাম্মদ সিনওয়ার নিহত হওয়ার খবরে। তবে হামাস বিষয়টি নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি, আর ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও কোনো মন্তব্য আসেনি।
ইসরাইলের এই সঙ্কটের মধ্যেও বন্দী মুক্তি চুক্তির পরিবর্তে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে দায়ী করেছেন এক বন্দীর মা। মাতান জাঙ্গাউকারের মা আইনাভ জাঙ্গাউকার এক্স-এ লিখেছেন, সরকার শুধু আংশিক চুক্তিতে আগ্রহী। তারা আমাদের কষ্ট দিচ্ছে ইচ্ছাকৃত। আমাদের সন্তানদের ফেরত আনুন, সব, ৫৮ জনকেই!
রাতের এক হামলায় দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসে একটি তাঁবুতে আঘাত হানে ইসরাইলি যুদ্ধবিমান। এতে নারী-শিশুসহ বহু মানুষ নিহত হন, আহত হন অনেকে এবং বেশ কয়েকটি তাঁবু আগুনে পুড়ে যায়। হামাস এই ঘটনাকে নতুন একটি নৃশংস অপরাধ বলে অভিহিত করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকেই এই সহিংসতার জন্য দায়ী করেছে।
আগের দফায় নিহতদের মধ্যে পাঁচজন সাংবাদিকও রয়েছেন, যাদের কেউ কেউ পরিবারসহ নিহত হন। গাজা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিষয়ক শিক্ষক এবং হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ভাই জাকারিয়া আল-সিনওয়ারও নিহত হয়েছেন এক বিমান হামলায়। ওই হামলায় তার তিন সন্তানও মারা যান। গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে ইসরাইলি হামলা ও হাসপাতালগুলোর ওপর অভিযানের ফলে। খাদ্য ও জ্বালানির অবরোধে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দেকরান বলেন, হাসপাতালগুলো শিশুসহ আহতদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। রোববার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, উত্তরের অন্যতম প্রধান কার্যকর ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল এখন আর চালু নেই। কারণ হাসপাতালের আশপাশে ইসরাইলি হামলা হচ্ছে।
শিফা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাতের হামলায় তারা ৪০টি লাশ এবং বহু আহতকে গ্রহণ করেছে। এর ফলে জরুরি রক্তের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলে সাধারণ মানুষের প্রতি রক্তদানের আহ্বান জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্যালেস্টাইনি সিভিল ইমার্জেন্সি সার্ভিস জানিয়েছে, তাদের ৭৫ শতাংশ অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ হয়ে গেছে জ্বালানি সঙ্কটে। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জ্বালানি সরবরাহ না হলে তাদের সব যানবাহন অচল হয়ে পড়বে বলে সতর্ক করেছে তারা।
যুদ্ধবিরতিতে নেতানিয়াহুর শর্ত : যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দখলদারদের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল বলেছেন, তারা হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা করছেন। তবে হামাস যদি গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চায় তাহলে সংগঠনটির যোদ্ধাদের গাজা ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং এ উপত্যকাকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করতে হবে বলে শর্ত দিয়েছেন তিনি। নেতানিয়াহু বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকোফের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব অথবা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি- দু’টিতেই তিনি রাজি আছেন। উইটকফের প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজায় ৪৫ দিনের যুদ্ধবিরতি হবে। এই সময়ে হামাস ১০ জিম্মিকে মুক্তি দেবে। অপরদিকে ইসরাইল নির্দিষ্ট ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেবে। যুদ্ধবিরতি চলাকালীন সময়ে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা হবে। অন্যদিকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হলে হামাস সব বন্দীকে একসাথে মুক্তি দেবে। তবে দখলদার নেতানিয়াহু বলেছেন, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চাইলে হামাসকে গাজার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে হবে এবং উপত্যকাটি অস্ত্রমুক্ত হতে হবে।
গতকাল রোববার এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর দফতর এ ব্যাপারে বলেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আলোচনাকারী দল কাতারের দোহায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে দেখছে- হোক সেটি উইটকফের প্রস্তাব অথবা যুদ্ধ সম্পূর্ণ বন্ধ করার কাঠামোতে। যার মধ্যে থাকবে সব বন্দীর মুক্তি, গাজা থেকে হামাসের নির্বাসন এবং গাজাকে নিরস্ত্রীকরণ।’ টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, নেতানিয়াহু এর আগে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এখন তার অবস্থানে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তবে হামাস এই দখলদারের প্রস্তাব মানবে কি না সেটি দেখার বিষয়।
মোহাম্মদ সিনাওয়ারের লাশ পাওয়া গেছে : এদিকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ সিনওয়ারের লাশ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সৌদির সংবাদমাধ্যম আল-হাদাছ। গত সপ্তাহে খান ইউনুসে মোহাম্মদ সিনওয়ারকে লক্ষ করে হামলা চালায় দখলদার সেনারা। আল-হাদাছ আরো জানিয়েছে, মোহাম্মদ সিনওয়ারের সাথে তার আরো ১০ সঙ্গীর লাশ পাওয়া গেছে। হামাসের সাবেক প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের ছোটভাই ছিলেন মোহাম্মদ সিনওয়ার। গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে গাজার রাফার তেল সুলতানে দখলদার ইসরাইলি সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে প্রাণ হারান ইয়াহিয়া। তার মৃত্যুর পর মোহাম্মদ সিনওয়ার হামাসের নেতৃবৃন্দের শীর্ষস্থানে চলে আসেন। তিনি হামাসের সামরিক শাখা ছাড়াও গাজার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
সৌদির সংবাদমাধ্যমটি রোববার জানিয়েছে, গত সপ্তাহের হামলায় হামাসের রাফা ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ শাবানাও প্রাণ হারিয়েছেন। দখলদার ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ এক বৈঠকে জানিয়েছেন, তাদের বিশ্বাস মোহাম্মদ সিনওয়ার গত সপ্তাহে নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ সিনওয়ারের মৃত্যুর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। কিন্তু সবকিছু নির্দেশ দিচ্ছে তিনি নিহত হয়েছেন।’
দীর্ঘদিন হামাসের সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ দেইফ। গত বছরের জুলাইয়ে দেইফ নিহত হওয়ার পর প্রথমে সামরিক শাখার দায়িত্ব পান মোহাম্মদ সিনওয়ার। এরপর তার ভাই ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ার পর তিনি পুরো গাজার দায়িত্ব পান। দখলদার ইসরাইলের কর্মকর্তাদের দাবি, মোহাম্মদ সিনওয়ারের কারণে বন্দিচুক্তি ও যুদ্ধবিরতি আটকে ছিল। মোহাম্মদ সিনওয়ার ১৯৯০ সালের দিকে ইসরাইলি কারাগারে ৯ মাস বন্দী ছিলেন। এরপর রামাল্লাহতে ফিলিস্তিনি অথরিটির কারাগারে তাকে আরো তিন বছর আটকে রাখা হয়। ২০০০ সালে তিনি ওই কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। ২০০৬ সালে ইসরাইলি সেনা গিলাদ শালিতকে ধরে আনেন হামাসের যোদ্ধারা। এতে মোহাম্মদ সিনওয়ার জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
গাজায় ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল বন্ধ : ইসরাইলি বাহিনীর তীব্র হামলায় উত্তর গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। টেলিগ্রামে এক বার্তায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর তীব্র হামলা ও অবরোধের কারণে হাসপাতালটি সেবা দিতে পারছে না।
ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের পরিচালক মারওয়ান আল-সুলতান বলেন, ‘হাসপাতালটি বর্তমানে ইসরাইলি বাহিনীর অবরোধের মধ্যে রয়েছে এবং কেউ নড়াচড়া করলেই গুলি করা হচ্ছে। এমনকি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটও (আইসিইউ) গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতাল আর কোনো সেবা দিতে পারছে না। অবিলম্বে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান হাসপাতালের পরিচালক। আলজাজিরার খবর অনুযায়ী, এর আগে বেইত হানুন হাসপাতাল ও কামাল আদওয়ান হাসপাতাল ধ্বংস করে দেয় দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। এবার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল অবরোধের মাধ্যমে উত্তর গাজার সবগুলো হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দিল আইডিএফ।