Image description
নেতাদের বক্তব্যে ইঙ্গিত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবিলম্বে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ না দিলে প্রয়োজনে রাজপথে নামতে পারে বিএনপি। গত দুদিনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলটির সিনিয়র নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপি এখনো ধৈর্য ধরে থাকলেও বর্তমান বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা করছে। এরপরও নির্বাচন আদায়ের ইস্যুতে এখনই রাজপথে নেমে সরকারকে ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতিতে ফেলতে চায় না তারা। দলটি মনে করে, এই সরকারের ব্যর্থতা মানে দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের ব্যর্থতা।

জানা গেছে, নির্বাচন ঠিক কবে হবে কিংবা সরকার নিজেদের দেওয়া রোডম্যাপের ধারণার মধ্যে নির্বাচন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে দলটির মধ্যে উৎকণ্ঠা ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও আরও কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রত্যাশা, সরকার অচিরেই রোডম্যাপের ব্যাপারটি স্পষ্ট করবে। নইলে ঈদুল আজহার পরে যুগপতের মিত্র দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারে। তখন ওই পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী হবে বলে মনে করে বিএনপি। অবশ্য দলটি এও মনে করে যে, সরকারের এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়, যেখানে নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার রাস্তায় নামতে হয়। তেমনটা হলে তা খুবই বিব্রতকর হবে।

বিএনপির দুজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে টালবাহানা করছে। নির্বাচনের কথা বললেই তারা সংস্কারের ইস্যু সামনে আনে। কিন্তু সংস্কারের প্রক্রিয়াও ধীরগতিতে এগোচ্ছে। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কোন সংস্কারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে করতে চায়, সরকার সেটিও বলছে না। সরকারের মতিগতি দেখে মনে হচ্ছে, তারা থেকে যেতে চায়। সুতরাং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নির্বাচনের দাবিতে আমাদের আবার হয়তো মাঠে নামতে হতে পারে। মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু কালবেলাকে বলেন, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের মানুষ অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন চায়। সেজন্য রাজপথে নামতে হবে কি না, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। সরকার যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে সংকট ঘনীভূত হবে না, বরং দূরীভূত হবে। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে, এই সরকার অবিলম্বে একটা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকার সৃষ্টির উদ্যোগ নেবে। আর সরকার যদি মূল কাজটা এড়িয়ে গিয়ে ক্ষমতায় থাকার চিন্তা করে, তাহলে সংকট তীব্রতর হবে। মানুষ অতীতে স্বৈরতন্ত্র মানেনি, তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এবং স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছে। জনগণ আবার স্বৈরতন্ত্রকবলিত হবে এবং তা মেনে নেবে, সেটা প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের মধ্যে বিভিন্ন পক্ষের নানান দাবি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বিভিন্ন পক্ষ নানামুখী এজেন্ডা নিয়ে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের সরকারের ওপরে ভর করেছে। ফলে পরিস্থিতি থেমে থেমেই অস্থির হয়ে উঠছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নির্বাচনই একমাত্র পথ বলে মনে করে দলটি। নেতারা বলছেন, সরকারের মেয়াদের নয় মাসেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করাটা একটা ‘রহস্য’। তাই এই ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে দলটি। গত দুদিনে পৃথক অনুষ্ঠানে কড়া বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন নেতারা।

গত শনিবার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে এনডিএমের অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরিস্থিতি অযথা ঘোলাটে না করে অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানান তিনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জনগণের ভোটে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে পতিত পলাতক স্বৈরাচারকে মোকাবিলা করা সহজ হবে না। তবে তিনি একই সঙ্গে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, লোভ-লাভের প্রলোভনমুক্ত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অচিরেই জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে বাংলাদেশে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করবে। তারেক রহমানের এই বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতি এক ধরনের ‘বার্তা’ বলে মনে করছেন অনেকে।

একই দিন খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে তারুণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সেখানে তিনি বলেন, এই সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা এবং সেটা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু মনে করবেন না যে, রোজ কিয়ামত পর্যন্ত আপনাদের আমরা এই জায়গায় দেখতে চাইব। আপনি কি চান, নির্বাচনের জন্য আপনার সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হোক? এ দেশের জনগণ যমুনামুখী লংমার্চ করুক?

সময়মতো নির্বাচন দেওয়া না হলে রাজপথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক বিরোধীদলীয় চিপ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক। গতকাল রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমান আমাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন, তাই আমরা ধৈর্য ধরে আছি। কিন্তু এই ধৈর্যের ফল যদি হয় নির্বাচন বিলম্বিত, তাহলে সেই ধৈর্যের বাঁধ আমরা ভেঙে ফেলব। মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তখন যদি আমাদের থামতে বলেন, আমরা থামব না। নির্বাচনের জন্য আমরা মাঠে নামবোই, যদি সময়মতো নির্বাচন দেওয়া না হয়। তিনি আরও বলেন, কোন দিন নির্বাচন দেবেন তা বলে দিতে অসুবিধা কোথায়? আমার মনে হয়, সরকার নির্বাচন দিতে বিলম্ব করছে কারও কারও শক্তি-সমর্থন জোগাড় করার জন্য। এসব টালবাহানা এ দেশে চলবে না। আমরা ভেসে আসি নাই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই সরকার এমনভাবে কাজ করছে যেন তারা একটি নির্বাচিত সরকার। অথচ এটি একটি অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। কিন্তু মেয়াদের নয় মাসেও এখনো নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন যত বিলম্বিত হচ্ছে, দেশকে তত বেশি অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। জাতি এখন এক গভীর শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছে। দেশ কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না। সবাই মিলে স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে। এরপর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশ পরিচালনার যে প্রত্যাশা ছিল, তা হয়নি। সরকারকে বলব, অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করুন।