Image description
উপকূলীয় জেলা বরগুনা » আ.লীগের আমলের জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুর্নীতি । » সুপেয় পানির সংকট নেই , এমন বাড়িতেও ট্যাংক স্থাপন । » টাকা নিয়েও করা হয়নি তালিকাভুক্তি , অভিযোগ অনেকের । » অনেকে বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি পান করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ।

সুপেয় পানির সংকট নেই , এমন বাড়িতেও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য ট্যাংক রাখা হয়েছে । এমন ট্যাংক দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে ঘুষ । এদিকে যেসব ট্যাংক দেওয়া হয়েছে , সেগুলো নিম্নমানের । কিছুদিন পরই সেসব ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে । এমন চিত্র উপকূলীয় জেলা বরগুনার । যেখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট । এই সংকট নিরসনে অর্থ ব্যয় করা হলেও সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে সুফল পায়নি ভুক্তভোগীরা । শীত ও গ্রীষ্মে পানির চরম সংকটে ভোগে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা । এই সংকট দূর করতে ‘ উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রকল্প ' নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ।

অনুসন্ধানে দেখা যায় , তালিকা প্রস্তুত থেকে ট্যাংক বিতরণ পর্যন্ত পাঁচটি ধাপে দুর্নীতি হয়েছে । ঠিকাদারের সঙ্গে সমন্বয় করে খোদ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনেকটা না দেখার ভান করে আছেন দৃশ্যমান এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে । পাঁচটি ধাপে ভয়াবহ দুর্নীতি বরগুনায় উপকূলে বসবাসরত অন্তত ছয় লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে ।

এ সংকট নিরসনে ২০২২-২৩ ও ২৩-২৪ অর্থবছরে পৃথকভাবে তিনটি প্যাকেজে ৭ হাজার ৫৬০ জনের নামের সুপারিশ করেন তৎকালীন বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু , বরগুনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম , বরগুনা -২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন, বামনা উপজেলা চেয়ারম্যান সাইতুল ইসলাম লিটু ও প্রকল্পের আওতাধীন ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা ।

অনুসন্ধানে দেখা যায় , পাথরঘাটার চরদুয়ানী , কালমেঘা , পাথরঘাটা সদর ও কাঁঠালতলি ইউনিয়ন , বরগুনা সদরের নলটোনা ও এম বালিয়াতলী ও বামনার ডৌয়াতলা ইউনিয়নে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের তালিকায় নাম নিশ্চিত করতে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে গ্রাহকের কাছ থেকে । যারা টাকা দিতে পারেনি , তাদের নাম আসেনি তালিকায় । পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও প্রকল্পের আওতায় সুবিধাভোগীরা বলছেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম কবিরকে টাকা দিতে হয়েছে এই প্রকল্পের তালিকায় নাম ওঠাতে ।

 তবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রাইসুল ইসলামের দাবি করেন , ‘প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে । এখনো কাজ চলমান আছে । ' তথ্য অধিকার আইনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে , গত দুই অর্থবছরে পৃথকভাবে তিনটি প্যাকেজে ৩৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় টেন্ডার পায় বরগুনার কামাল এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান । এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কামাল হোসেন বলেন , ‘ কিছু প্ল্যাটফর্ম বৃষ্টির মৌসুমে নির্মাণ করা হয়েছে , তাই সমস্যা হয়েছে । এ ছাড়া তালিকাভুক্ত সবাই ট্যাংকসহ সবকিছুই পাবেন , একটু সময় লাগবে । ’

অনুসন্ধানে দেখা যায় , টেন্ডারের প্রথম বিল উত্তোলনের জন্য কিছু কিছু বাড়িতে ৩ হাজার লিটার পানি ধারণক্ষমতার ট্যাংক রাখার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন ঠিকাদার । তবে নিম্নমানের কাজ করায় ট্যাংক স্থাপনের আগেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সেসব প্ল্যাটফর্ম । যেমন পাথরঘাটার চরদুয়ানী এলাকার মোস্তফা হাওলাদার বাড়ির মসজিদের সামনে এবং মিল্টন সমাদ্দারের বাড়ির মন্দিরের পেছনে দুটি ট্যাংক এবং শেড পাওয়ার কথা থাকলেও মসজিদ ও মন্দির ঘুরে দেখা যায় , আড়াই বছর আগে ট্যাংক রাখার প্ল্যাটফর্ম করে চলে গেছে ঠিকাদার । এ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি । ঠিকাদারের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই আরও বেশ কিছু জায়গায় । বরগুনা সদরের ৯ নম্বর এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের মাইঠা এলাকা । এই এলাকায় সুপেয় পানির কোনো সংকট নেই । অধিকাংশ বাড়িতে রয়েছে গভীর নলকূপ । এই এলাকার সচ্ছল বাসিন্দা আবুল হোসেন , ফরহাদ হোসেন , মনির খান , শহিদুল ইসলামসহ অসংখ্য পরিবারের নাম রয়েছে ওই তালিকায় । অথচ তালিকাভুক্তদের অনেকের বাড়িতে গভীর নলকূপ ও সুপেয় পানির পুকুর রয়েছে । এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন , ‘ আমি সদ্য দায়িত্ব নিয়েছি । বিষয়গুলো আমাকে জানতে হবে । না জেনে এ বিষয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না । ”

ভুগছে জনসাধারণ বরগুনার পাথরঘাটার পদ্দা বেড়িবাঁধ থেকে পাশের গ্রামের পদ্দা এলাকায় সুপেয় পানি আনতে যান ৬০ বছরের বৃদ্ধ ধলু মিয়া । এক শিক্ষকের উদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবে স্থাপন করা ফিল্টার থেকে প্রতিদিন ৩৫ লিটার সুপেয় পানির জার কাঁধে নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন তিনি । শুধু ধলুই নন , পদ্দা গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার সুপেয় পানি সংগ্রহের চিত্র এটি । কখনো দিনের শুরুতে আবার কখনো দিনের শেষে লাইনে দাঁড়িয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হয় তাঁদের । এলাকাবাসী জানান , পানিতে লবণাক্ততা ও নলকূপ স্থাপনের সুযোগ না থাকায় বৃষ্টি মৌসুম শেষ হলেই এভাবে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাঁদের । পদ্দা এলাকার ধলু মিয়া বলেন , “ আমরা গরিবেরা এই প্রকল্পের সুবিধা পাই না । কারণ , টাকার বিনিময়ে তালিকা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার চ্যালারা । ’