
সাধারণত নদী বা সমুদ্রবন্দর, কয়লা খনিসহ প্রাকৃতিক সম্পদ ইস্যুতে বাম রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হলেও এবার চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ইস্যুতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো সবচেয়ে বেশি সরব। মূলত চারটি কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। সেগুলো হচ্ছে—অর্থনৈতিক ঝুঁকি তথা রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা; স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ঝুঁকি; দেশীয় কোম্পানির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা এবং বন্দর হাতছাড়া হওয়ার ভয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বন্দর পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে দেওয়া নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ‘চক্রান্ত’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। এর বিরুদ্ধে পৃথকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ডান-বামসহ সব রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণসংহতি আন্দোলন। প্রায় সব দলের মূল কথা, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি কোনোমতেই বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া যাবে না।
গত শনিবার সন্ধ্যায় এক আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘করিডোর কিংবা বন্দর দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ নয়। এ সিদ্ধান্ত নেবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ বা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার।’
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘দেশ বাঁচাও, বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য শাহাদাত হোসেন সেলিম গতকাল রোববার কালবেলাকে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি কোনোভাবেই বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া যাবে না। সরকার এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে শিগগির প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ বছর আগে এনসিটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে দেশি কোম্পানি দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে টার্মিনালটি। খুবই স্মুথলি বন্দরের কার্যক্রম চলছে। কেউ বিদেশি অপারেটরের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। কারও কোনো অভিযোগও নেই। এনসিটি একটি আয়বর্ধক প্রতিষ্ঠান। এই টার্মিনালের পাশেই রয়েছে নৌবাহিনীর নিরাপত্তা ঘাঁটি। ফলে সেখানে নতুনভাবে বিনিয়োগের যেমন কিছু নেই, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ঝুঁকিতে পড়বে। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কাও প্রবল হবে।
তিনি বলেন, ‘মূলত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুলের জামাই দুবাই কারাগারে আটক থাকার সময় তার মুক্তির জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি দুবাইয়ের দুবাই পোর্ট বা ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার বিনিময়ে লবিস্ট হিসেবে নিয়োগ করার পদক্ষেপ নেন শেখ হাসিনার তৎকালীন বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। পরবর্তী সময়ে সেটি নানা কারণে আর সম্ভব হয়নি। এরপর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এলে আমরা ১২-দলীয় জোট যখন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করি, তখন লিখিত ও মৌখিকভাবে এনসিটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছি। তবে এখন শোনা যাচ্ছে আওয়ামী আমলের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী এ নিয়ে কাজ করছেন। তা ছাড়া সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা ধোঁয়াশাপূর্ণ। এর পরও যা করা হচ্ছে, তা হয় জেদ কিংবা লোক দেখানো।’
শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, মূলত কোনো বন্দরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আনা হয় দুটি কারণে। এর একটি হলো বিনিয়োগ পাওয়া, আর অন্যটি হলো দক্ষতা বৃদ্ধি। কিন্তু নিউমুরিং টার্মিনালে নতুন করে এসব খাতে বিনিয়োগের সুযোগ যেমন নেই, তেমনি পাশেই নৌঘাঁটি থাকায় এটি সম্প্রসারণেরও সুযোগ নেই। বরং বিদেশি কোম্পানিকে বে-টার্মিনাল বা লালদিয়ার চর দিলে তারা সেখানে আধুনিক জেটি গড়ে তুলতে পারবে। আমরা বিদেশি বিনিয়োগ বা বিদেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে নই। তবে সেটি নতুন জায়গায় হোক।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব সাজিদুর রহমান উদ্বেগ জানিয়ে গত শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে মানবিক করিডোর বা বন্দর হস্তান্তর চলবে না। হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘বন্দর কোনোমতেই কাউকে দেওয়া যাবে না। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এমন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন সম্পর্কিত। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়া হলে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর নজর পড়বে। অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালানের আশঙ্কা থাকবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, ‘বন্দর হচ্ছে একটি দেশের কৌশলগত বিষয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল তো নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এবং পরিচালিতও হচ্ছে। তাহলে বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হবে কেন? আমাদের যদি আরও বন্দর থাকত, তাহলে বলতাম যে পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে, বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া যায়। সেরকম তো কিছু নয়। তাহলে অন্য কাউকে ডাকব কেন?’
প্রিন্স আরও বলেন, ‘বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। জাতীয় অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে। অথচ এই সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব এ বিষয়ে খুবই জবরদস্তি করছেন। যেটি তারা করতে পারেন না। তারা অনির্বাচিত। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, তা না হলে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রভাব বিস্তার করবে।’
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হতে পারে না। বন্দরে আধুনিক প্রযুক্তি আনা হয়েছে। দেশীয় ব্যবস্থাপনায় এটি লাভজনক। তাহলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কেন? এর সঙ্গে নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও আছে। সরকারের উচিত হবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।’
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের টেকসই অর্থনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমরা কিছুই পারছি না বলে অন্য কাউকে দেব—এ ধরনের প্রবণতা বিগত সরকারেরও ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারও তাই করছে। বন্দর নিয়ে চুক্তি করার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। বরং তারা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে নীতিমালা করতে পারে। কিন্তু তারা জবরদস্তি করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার যে কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে, সেই কোম্পানি কিন্তু আমেরিকার কোনো বন্দর নিতে পারেনি। আমেরিকা তাদের গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া অন্যান্য ঝুঁকি তৈরি হবে। আমরা সেই ঝুঁকিতে যাব কেন?’
অন্যদিকে বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ‘বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেছেন, সরকার সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন, তবে দেখতে হবে সেটা উইন-উইন হচ্ছে কি না। নিউ মুরিং তো ভালো করছে। লোকসানেও নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষও এর মাধ্যমে দক্ষ হয়ে উঠছে। এ ব্যবস্থাপনার সুযোগ বন্দর কর্তৃপক্ষ না পেলে একটা সময় পর যখন বিদেশিরা বন্দর বা টার্মিনাল হস্তান্তর করবে তখন কারা কীভাবে চালাবে।
আর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত ওয়াটসন গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইঞ্জিনিয়ার মো. আশরাফ উদ্দিন বকুল বলেছেন, শুরুতে সাইফ পাওয়ারটেক নামে একটি কোম্পানি ছোটখাটো কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে তারা বিগত দিনে সাইফ পাওয়ারটেক বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনা করত। তবে তাদের লাভের বিরাট অংশ এ দেশের ফ্যাসিস্ট প্রশাসন খেয়ে ফেলত। এখন বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করা হলে তারাও বিরাট একটা রাজস্ব নিয়ে যাবে। আমরা নিজেরা ব্যবস্থাপনায় থাকলে সেই রাজস্ব নিজেরাই পাব, এটিই বড় কথা।
তিনি বলেন, এক কথায় বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দিলে বাংলাদেশ রাজস্ব হারাবে। অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানি ডলার পেমেন্টের কারণে বেশি পরিমাণ লাভবান হবে। সুতরাং দেশি কোম্পানির মাধ্যমে সমন্বয় করে বন্দর হ্যান্ডেল করা হোক। এ বিষয়ে বিদেশে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই হতে পারে না।