২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল যেন শিক্ষা অঙ্গনে এক অঘোষিত ভূমিকম্প ডেকে এনেছে। গত ১৭ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন পাসের হার নিয়ে দেশজুড়ে উদ্বেগ বিরাজ করছে। ২০২৪ সালে ১৩ দশমিক ৩ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে যেখানে ১০ দশমিক ৩ লাখ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। সেখানে এ বছর ১২ দশমিক ৫ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৭ লাখ ২৭ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রায় ৫ লাখ শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ। যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
এই ফলাফলের সরাসরি অভিঘাত পড়বে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায়, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে গেলে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সংকটে পড়বে, যা প্রশাসনিক পরিচালনা থেকে শুরু করে শিক্ষার মানেও প্রভাব ফেলতে পারে।
শিক্ষা খাতে আসন সংখ্যা বনাম ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম বর্ষে আসন রয়েছে ৫০ হাজার ৪৫৫টি। সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে আছে আরও প্রায় ৫ হাজারটি আসন। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার আসন রয়েছে। সর্বাধিক আসন আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে—প্রায় ১১ লাখ।
সব মিলিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট আসন সংখ্যা প্রায় ১৩ দশমিক ২০ লাখ। অথচ ২০২৫ সালে পাস করেছে মাত্র ৭ লাখ ২৭ হাজার শিক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক আসনই খালি থাকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় : বাড়ছে সংখ্যা, কমছে শিক্ষার্থী
দেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৬টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। গত ১৭ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে রকেটের গতিতে। কিন্তু শিক্ষার্থীর সংখ্যা সে হারে বাড়েনি। কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আগের বছর থেকেই ভর্তি সংকটে ভুগছে।
গত ৮ অক্টোবর প্রকাশিত ব্যানবেইজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে প্রায় ১০ দশমিক ৫০ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল মাত্র ৪৯ হাজার ৮৮৩ জন। অপরদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার শিক্ষার্থী।
এই বছর সেই সংখ্যা আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, কারণ যোগ্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ কমে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভর্তির চ্যালেঞ্জ
শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও উচ্চশিক্ষায় ভর্তির সংকট দেখা দিয়েছে। ভারতের জাতীয় শিক্ষা পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের হার কমে গেছে প্রায় ১০ শতাংশ। নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে পুরো অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রতিযোগিতা যেমন কমছে, তেমনি বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাত টিকে থাকার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী আকর্ষণের দিকেও নজর দিতে হবে। দক্ষিণ এশীয় শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচির (SAARC Education Exchange) মতো উদ্যোগকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে আঞ্চলিক শিক্ষা বাজারে প্রবেশ করা যেতে পারে।
চ্যালেঞ্জের ধরন
১. ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর ঘাটতি
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় যোগ্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আসন পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষত মধ্যম মানের ও নবীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পূর্বে যেখানে ভর্তি মৌসুমে প্রতিযোগিতা দেখা যেত, এখন অনেক প্রতিষ্ঠান ভর্তি নিশ্চিত করতেও প্রচারণা চালাতে বাধ্য হচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরেই বহু বিশ্ববিদ্যালয় টিকে থাকার ঝুঁকিতে পড়বে।
২. আর্থিক অনিশ্চয়তা
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। কোনো সরকারি অনুদান বা বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় ভর্তি কমে গেলে সরাসরি প্রভাব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে। বেতন, অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ, আইটি সেবা, গবেষণা তহবিল—সব খাতেই দেখা দেয় ঘাটতি। ফলস্বরূপ, অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ছাঁটাই, কোর্স বন্ধ করা কিংবা একীভূতকরণের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি শিক্ষা খাতের মান ও স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৩. মান ও আস্থা সংকট
দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো মানসম্পন্ন শিক্ষা, যোগ্য শিক্ষক ও গবেষণা সংস্কৃতির দিক থেকে পিছিয়ে আছে। অনিয়ম, স্বচ্ছতার অভাব ও দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এখনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে। আস্থা হারালে ভর্তি সংখ্যা আরও কমবে—যা পুরো খাতের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করবে।
৪. শিক্ষক ধরে রাখা ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ
শিক্ষার্থী কমে গেলে আর্থিক সংকটের কারণে প্রথম আঘাত আসে শিক্ষক ও কর্মচারীদের ওপর। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা ভালো সুযোগের সন্ধানে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যান, যা একাডেমিক মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি ক্লাসরুম, ল্যাব, আইটি অবকাঠামো ও গবেষণা সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কমিয়ে দিতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্রমে নিচের দিকে নামে এবং ‘টিকে থাকার চক্রে পড়ে’ যায় প্রতিষ্ঠানটি।
চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জন্য করণীয়
১. গুণগত মানে জোর দেওয়া
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত এখন ভর্তি সংখ্যা নয়, মানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া। আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলাম, অভিজ্ঞ শিক্ষক, গবেষণা সহযোগিতা ও ইন্ডাস্ট্রি-লিংকড কোর্স চালুর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা সম্ভব। উচ্চশিক্ষাকে শুধু ডিগ্রি নয়, বরং ‘চাকরির উপযোগী দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
২. ডিজিটাল শিক্ষার সম্প্রসারণ
বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা এখন হাইব্রিড ও অনলাইনমুখী। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, বিদেশি যৌথ কোর্স এবং ভার্চুয়াল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারে। এতে আয়ের নতুন উৎস তৈরি হবে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বাড়বে।
৩. আঞ্চলিক সহযোগিতা
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষার্থীর বিনিময়, ক্রেডিট ট্রান্সফার এবং যৌথ গবেষণা কর্মসূচি চালু করা জরুরি। SAARC বা BIMSTEC পর্যায়ে শিক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো গেলে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আঞ্চলিক পর্যায়ে নতুন বাজার তৈরি করতে পারবে। এতে শিক্ষার্থী ঘাটতির প্রভাব অনেকাংশে কমে আসবে।
৪. দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা
বর্তমান চাকরির বাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন ‘স্কিল-অরিয়েন্টেড’ কোর্সে জোর দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি, বিজনেস অ্যানালিটিক্স, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক কোর্স চালু করলে শিক্ষার্থীরা কর্মসংস্থানে এগিয়ে থাকবে, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে।
৫. সরকারি সহায়তা
সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কর ছাড়, গবেষণা অনুদান, ও মান নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। এছাড়া ইউজিসির তত্ত্বাবধানে ‘Private Higher Education Stabilization Fund’ গঠন করা হলে সংকটকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে টিকে থাকতে পারবে।
উপসংহার
২০২৫ সালের ফলাফল শুধু পরীক্ষার্থীদের নয়, গোটা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক সতর্কবার্তা। শিক্ষার্থী কমে গেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে টিকে থাকতে পারবে কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটেও এটি এক আঞ্চলিক সংকটের রূপ নিচ্ছে।
সরকার, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এখনই সম্মিলিতভাবে পরিকল্পনা নিতে হবে—নতুবা আগামী এক দশকের মধ্যেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো কেবল ইতিহাসের পাতায় টিকে থাকবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ