
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন লিখিত পরীক্ষায় ‘অনুত্তীর্ণ’ হওয়া শিক্ষার্থীরা। ‘স্বজনপ্রীতিমূলক’ আখ্যা দিয়ে নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদনও করেছেন তারা। আজ মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক সুবেল আহমেদের কাছে এই অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়টি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন দুদক জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হামেদ রেজা। এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়মানুযায়ী উদ্যোগ নিবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বর্তমানে ৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে দুজন অধ্যাপক, দুজন সহযোগী অধ্যাপক ও একজন সহকারী অধ্যাপক। বিভাগের শিক্ষক সংকট নিরসনে চলতি বছরের ১৯ মে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে দুজন প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে লিখিত ও বিকেলে ভাইভা (মৌখিক পরীক্ষা) অনুষ্ঠিত হয়। এই নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন কাদেরী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন। তিনি রাবির ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাক্যুরেসি সেলের অতিরিক্ত পরিচালক। তবে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একাধিক গুরুতর অনিয়ম, পক্ষপাতদুষ্টতা ও স্বজনপ্রীতি লক্ষ্য করেছেন এ দুই শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ফারসি বিভাগের প্রভাষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর মোট ৪৩ জন আবেদন করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন ১৩ জন। তবে লিখিত নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন মোট ২৯ জন, যার মধ্যে চবির শিক্ষার্থী ছিলেন মাত্র ১১ জন। লিখিত পরীক্ষায় তারা কেউ উত্তীর্ণ হতে পারেননি বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরীক্ষার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তারা উভয়েই বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন। এর মধ্যে সুপারিশ পাওয়া ঢাবি শিক্ষার্থী অনার্সে ৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
এদিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভাইভায় ডাকা হয়নি উল্লেখ করে দুদকে দেওয়া অভিযোগপত্রে চবির ফারসি বিভাগের ১০ শিক্ষার্থী সই করেছেন। তারা হলেন ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের কামরুল হাসান, মায়মুনা আক্তার, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের আশরাফুন নেছা, মহিমা আক্তার প্রিয়া, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের মো. আকিব, কাজী নউরিন জাহান, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের সুমাইয়া ইসরাত রাফি, মিলাদ হোসাইন, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম বিনতে আহাদ ও নাইমুল হাসান রাহাত। পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া আরেক শিক্ষার্থী ঢাকায় থাকায় অভিযোগ দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন না বলে জানা গেছে।
“লিখিত পরীক্ষার খাতা সাধারণত কোডিং করা হয়। কিন্তু কোডিং করার আগে যারা খাতা কাটবেন তারা প্রত্যেকের খাতা এসে এসে দেখছিলেন। বিশেষ করে যাদের প্রার্থী ছিল, ওই প্রার্থীদের খাতাগুলো এসে এসে ধরে দেখছিলেন। প্রশ্ন না বুঝলে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এটা কিন্তু নিয়মের বাইরে। পরীক্ষা নিয়ে খাতা কোডিং করার পর মূল্যায়নের জন্য যাবে। এখন কোডিং করার আগে কে কিভাবে লিখছে তা যদি দেখে ফেলেন, তাহলে তো আপনি চিনে ফেললেন, ইচ্ছামতো নম্বর দিতে পারবেন।”
অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে সিনিয়র অধ্যাপক থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো শিক্ষককে নিয়োগ বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং তাদের থেকে কোনো সহযোগিতা চাওয়া হয়নি। এ ছাড়া বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির অনুমোদন ছাড়াই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। উপরন্তু নিয়োগ বোর্ডে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের একজন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের একজন শিক্ষককে বিশেষজ্ঞ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিএ ও এমএ ডিগ্রিধারী নন। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে নিজস্ব শিক্ষার্থীর ভাইভার জন্য বিশেষজ্ঞ করা হয়েছে।
একই সাথে লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নকারীরা পরীক্ষার হলে উপস্থিত থেকে প্রার্থীদের উত্তরপত্র দেখছিলেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে তাদের আবেদনে। শিক্ষার্থীরা লিখেছেন, খাতা মূল্যায়নকারীরা প্রার্থীদের প্রশ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন-যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। এ ছাড়া বিভাগের প্রথমসহ যোগ্য প্রার্থীদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের ভাইভার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এসব ঘটনাবলি শুধু প্রহসনমূলক নয়, বরং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগকে অপমানিত করা হয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ার ন্যায়পরায়ণতা ও স্বচ্ছতার পরিপন্থী।
এতে প্রহসনমূলক ও স্বজনপ্রীতিমূলক নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক সিলেকশন এবং নিয়োগ অবিলম্বে প্রত্যাহার করে বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন নিয়োগ বোর্ড গঠন করার দাবি জানানো হয়। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন মেনে যথাযথভাবে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা এবং স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার দাবিও জানান তারা।
ভাইভা ও প্রেজেন্টেশনে ডাক না পাওয়া এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, লিখিত পরীক্ষার খাতা সাধারণত কোডিং করা হয়। কিন্তু কোডিং করার আগে যারা খাতা কাটবেন তারা প্রত্যেকের খাতা এসে এসে দেখছিলেন। বিশেষ করে যাদের প্রার্থী ছিল, ওই প্রার্থীদের খাতাগুলো এসে এসে ধরে দেখছিলেন। প্রশ্ন না বুঝলে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এটা কিন্তু নিয়মের বাইরে। পরীক্ষা নিয়ে খাতা কোডিং করার পর মূল্যায়নের জন্য যাবে। এখন কোডিং করার আগে কে কিভাবে লিখছে তা যদি দেখে ফেলেন, তাহলে তো আপনি চিনে ফেললেন, ইচ্ছামতো নম্বর দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, খাতা যাচাই যারা করবেন, তারা পরীক্ষার হলে থাকতে পারবেন না। কিন্তু উনারা ছিলেন। এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যায় না। আরেকটা বিষয় হল আমাদের বিভাগ থেকে নিয়োগ বোর্ডের জন্য চারজনের নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু কাউকে রাখা হয়নি। পরে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে গিয়েছি। ২৯ পৃষ্ঠার একটা স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নিজেদের প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইয়াহইয়া আখতার ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে রাজি হননি। জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতি হয়নি। নিয়মানুযায়ী ভাইভা বোর্ড যেভাবে গঠন হওয়া দরকার, সেই প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ করে গঠিত হয়েছে। আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুটি ধাপ। একটা হলো রিটেন (লিখিত) পরীক্ষা, আরেকটা ভাইভা। এখন যারা লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেননি, তাদের কাছে মনে হয়েছে এখানে দুর্নীতি হয়েছে। আসলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে এ পর্যন্ত কোন দুর্নীতি হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. শামিম উদ্দিন খান বলেন, আমাদের পরীক্ষায় কোনো নাম থাকে না, একটা কোড নম্বর থাকে। ফলে স্বজনপ্রীতি হওয়ার সুযোগ নেই। যে দুজনকে সুপারিশ করা হয়েছে তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ফোর আউট অব ফোর পাওয়া শিক্ষার্থী। অপর শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে তো ভাইভায় কাউকে ডাকার সুযোগ নাই। আমরা যা চাচ্ছি, তার সাথে এটা যায় না। আমরা উচ্চ মান সম্পন্ন শিক্ষক চাচ্ছি।
নিয়োগ বোর্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, বোর্ডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক ছিলেন, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকিউএসির অতিরিক্ত পরিচালক। আইকিউএসিতে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সেরা এবং গুণী শিক্ষককে দেওয়া হয়, ভালো গবেষককে দেওয়া হয়। আরেকজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষক, যিনি উর্দু, আরবি এবং ফারসি ভাষায় পারদর্শী। ফলে সিন্ডিকেট তাদের বিবেচনা করেছে। আমরা মূলত দেশ সেরা শিক্ষকদের বোর্ডে রাখার চেষ্টা করেছি।