Image description
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন, এক টাকাও ব্যয় করেনি ২০টি, ১ থেকে ৫ লাখ টাকা ব্যয় ২৪টির, ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয় ৮টির, সর্বোচ্চ ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

২৪ বছর আগে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হাজার ৮৮ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। অথচ ২০২৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণা খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি। একই অবস্থা ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিটি ইউনিভার্সিটির।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচ হাজার ৭৫৩ জন শিক্ষার্থী থাকলেও তাঁরাও গবেষণায় কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে দ্য পিপল’স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণায় কোনো অর্থ ব্যয় করেনি।

২০২৩ সালের তথ্য নিয়ে গত সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতে ভয়াবহ দুরবস্থার চিত্র উঠে আসে।
তবে ওই বছর গবেষণা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয় করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ৬৪ কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস গবেষণা খাতে জোর দিয়েছে। তারা ধারাবাহিকভাবে এই খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে। 

বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় মোটেও আগ্রহ নেই।
আবার এক টাকাও ব্যয় করেনি ২০ বিশ্ববিদ্যালয়। এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় করেছে ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। আর পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে আট বিশ্ববিদ্যালয়। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে নাম ওঠানোর জন্য নামকাওয়াস্তে কিছু ব্যয় দেখিয়েছে, যা মূলত গবেষণা খাতের ব্যয় নয়।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে গবেষণা খাতে খুব করুণ অবস্থা ছিল। আমাদের কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের কমপক্ষে দুই শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় করতে হবে। এটা আমরা সব বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েছি। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাজও শুরু করেছে। ২০২৪ সালে কিছুটা উন্নতি হবে। ২০২৫ সালের তথ্য নিয়ে যে বার্ষিক প্রতিবেদন, সেখানে আরো উন্নতি দেখা যাবে। তবে ২০২৬ সালের তথ্যে আমরা গবেষণা খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখতে পারব। আসলে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।’

ইউজিসি সূত্র জানায়, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৬টি। তবে ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের সময়ে ২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১১০টি। সে সময় সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। এ ছাড়া চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। ফলে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকা ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশির গবেষণায় আগ্রহ দেখা যায়নি। ওই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫৮ হাজার ৪১৪ জন।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় এক নয়। প্রথাগত পড়ালেখার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো অনেক কাজ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হলো জ্ঞান সৃষ্টি ও গবেষণা এবং জ্ঞান বিতরণ ও সংরক্ষণ। এর মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা হয়। জ্ঞানের সীমানা প্রসারিত করা হয় এবং মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। তারা শুধু শিক্ষার্থী ভর্তি ও তাদের সনদ দেওয়ায় ব্যস্ত। কে কতটুকু শিখতে পারল সেদিকে তাদের নজর নেই। পাস করা শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে যুক্ত হতে পারল কি না সে ব্যাপারেও তাদের খেয়াল নেই।

যদিও সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে ইউজিসি কোনো সুপারিশ করেনি। তবে কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলোচনাক্রমে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। এতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সমস্যা ও চাহিদার কথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানাতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী কাজ করার পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যার উপায় বের করে দেবেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাবে এবং পণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। এ ধরনের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে সাবলম্বী হয়ে রাষ্ট্রের বাজেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারবে।

২০২৩ সালে গবেষণায় এক টাকাও ব্যয় না করা আরো বিশ্ববিদ্যালয় হলো ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, জেড. এইচ. সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ, আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি, জেড. এন. আর. এফ. ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস, আহসানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি।