
চাচ্চু’খ্যাত ঢাকাই সিনেমার শক্তিমান অভিনেতা ও প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজল একাধারে সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী এবং দানবীর। তার এই কর্মব্যাপ্তি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজারজুড়ে বিস্তৃত। স্থানীয়ভাবে তিনি অসহায়ের সহায় হিসেবে পরিচিত। ব্যক্তিগভাবে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ ও সংস্কারে তার উদারহাত সর্বজন বিদিত। প্রতিবেশি সনাতম ধর্মের একজন বন্ধু হিসেবেও রয়েছে তার জনপ্রিয়তা। এছাড়াও দেশের যে কোনো প্রান্তের যে কেউ তার কাছে আসলে খালি হাতে ফিরেছেন এমন নজির নেই। ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ শিল্পী-পরিচালকদের আস্থার নাম ডিপজল। এসকল কর্মকান্ডে একদিকে যেমন জুটেছে অসংখ্য সুভানুধ্যায়ীর তেমনি কিছু স্বার্থন্বেষী মহলের শত্রুতাও জুটেছে।
সবকিছুর পরও নিজেকে সরিয়ে নেন নি বরং সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন উদারহস্তে। সে নমুনা দেশবাসী দেখেছে জুলাই ২৪ গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পাশে নিজ সন্তানদের প্রশংসনীয় উদ্যোগে। একইভাবে গণ-অভ্যুত্থানের পরপর দেশব্যাপী সৃষ্ট বন্যায় প্রত্যন্ত এলাকায় ট্রাকের পর ট্রাক অনুদান স্বয়ং শত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না। সাড়া মাস রোজাদারদের মাঝে ইফতার বিতরণ ছিলো দারুন এক উদাহারণ। বাদ যায়নি প্রিয়কর্মস্থল এফডিসিও। সবকিছুর পরও এই মানুষটি অজানা কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে! দীর্ঘ আট মাস ডিপজলকে কেউ দেখেনি।
এই সময়ে প্রিয় কর্মস্থল এফডিসির অসংখ্য শিল্পী-কুশলীরা শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডিপজলের অভাব অনুভব করছেন। বিশেষ করে কর্মহীন হয়ে পড়া অন্তত পাঁচ শতাধিক শিল্পী, কলা-কুশলীর পরিবারবৃন্দ। ডিপজল অন্তরালে, নতুন সিনেমার মহরত নেই, নেই সেই আগের ব্যস্ততা। কর্মহীন মুখ ভেসে বেড়ায়। অপেক্ষায় একজন প্রযোজক ডিপজলের। একজন দানবীর ডিপজলের। ডিপজলের প্রতি কলা-কুশলীদের ভালোবাসার অন্যতম কারণ— তিনি কলা-কুশলীদের কথা মাথায় রেখে দেশীয় উপজীব্য সিনেমা নির্মাণ করেন।
তার ভাষায়— “সিনেমা বাঁচাতে হলে পরনির্ভরশীল হলে চলবে না, দেশীয় অভিজ্ঞদের কাজে লাগাতে হবে। অন্যদেশের ম্যানুফেকচারিং সিনেমা দিয়ে আমাদের লোকজন বেকার হয়ে পড়বে, আমি এটা করতে পারবো না। আমার যা আছে তা দিয়ে ওদের নিয়ে যতদিন সম্ভব কাজ করবো”।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে—পতিত সরকারের লোকজন গত বছরের ৩ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে এফডিসিতে মানববন্ধনে আসার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। এ অবস্থায় ছাত্র-জনতার অসহায় মৃত্যু তাকে বিচলিত করে। কাছের বিনোদন সাংবাদিকদের পরামর্শে শেষপর্যন্ত তিনি এফডিসিতে মানববন্ধনে দাঁড়াননি। এ সময় তৎকালীন সরকারের লোকজন তাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেয় বলে এলাকাসূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ওই সূত্রের খবর— সাধারণ শান্তিকামী মানুষের সহায় ডিপজল যখন সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীল অবস্থা এড়াতে মন্দিরে মন্দিরে পাহাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়ে সকলের প্রশংসায় ভাসছেন, ঠিক সে সময় সুযোগ সন্ধানী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দেওয়া মামলা এফডিসির মানুষদের বিচলিত করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান ডিপজল। আর যে কারণে শিল্পী সমিতির পিকনিক, রোজায় ইফতার, ঈদ উপহার কোনো কিছুই ডিপজলসুলভ হয়নি। হাহাকার মুখগুলো ঘুরে বেড়ায়, দীর্ঘশ্বাসে ভারি হতে থাকে এফডিসি।
এ অবস্থায় একজন ডিপজলের সমহিমায় ফেরা জরুরি বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন পরিচালক-সাংবাদিকবৃন্দ।
চাচ্চু সিনেমার নির্মাতা বরেণ্য পরিচালক এফআই মানিক বলেন, নিজ এলাকা বলেন আর ইন্ডাস্ট্রির লোক হিসেবে যেভাবেই বলেন এজনক ডিপজলের অবদান অনেক। তিনি একজন দক্ষ অভিনেতা। একজন পেশাদার প্রযোজক। গত আট মাসে ঠিকঠাক ক্যামেরা ওপেন হয়নি, ডিপজল ওপেন থাকলে এটা হতো না। বর্তমান সরকারের প্রতি অনুরোধ ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থ বিবেচনায় তাকে সহযোগিতা করুন।
ওরা ৭ জন সিনেমা’খ্যাত নির্মাতা ও সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট খিজির হায়াত খান বলেন, যখন বিএফডিসির অনেক শিল্পী আর কলাকুশলী কাজের অভাবে না খেয়ে থাকতো তখন ডিপজল ভাই তাদের অন্নের সংস্থান করতো। এই একটি কারণে তিনি যদি বিগত সরকারের আমলে কোনো রাজনৈতিক ভুল করে থাকে তাকে ক্ষমা করা উচিত। যতদূর জানি মনে প্রাণে তিনি ছাত্র জনতার পাশেই ছিলেন। বাকিটা তদন্ত সাপেক্ষ।
বাচসাস-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রিমন মাহফুজ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মনোয়ার হোসেন ডিপজল একজন মানবিক শিল্পী। শিল্পীদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় থাকে না। তিনি শিল্পী সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। তিনি শিল্পীদের কল্যানে সব সময় কাজ করেন। প্রায়ই অসহায় মানুষের জন্য মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এই কয়দিন আগে রোজাদারদের কল্যাণে ডিপজলের মাসজুড়ে ইফতার আয়োজন করেছিলেন। তাছাড়া জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে তার অবদান ছিল। আমরা সকলেই জানি ছাত্রদের আন্দোলন এবং পরবর্তীতে দেশজুড়ে সহিংসতার জেরে সরকার পতনের এক দফা দাবির আন্দোলনে ডিপজলের দুই ছেলে শাদমান মনোয়ার অমি ও সামির মনোয়ার অংশ নিয়েছিলেন।
সিনিয়র বাচসাস সদস্য ও খবর পত্রিকার বার্তা সম্পাদক শপথ চৌধুরী বলেন, ডিপজল দেশীয় চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা, প্রযোজক ও দানবীর। তিনি চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকলের মন জয় করেছেন। নিজ এলাকাতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। অথচ গত কয়েক মাস এই মানুষটি লোকচক্ষুর আড়ালে। শুনেছি সেটা রাজনৈতিক কারণ। যেটাই হোক না কেন একজন শিল্পী ডিপজল দেশ বিরোধী এমন কোনো কাজ করতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি না যা তাকে আড়ালে নিয়ে গেছে। আমাদের বিশ্বাস ইন্ডাস্ট্রির স্বার্থে সরকার অবশ্যই তার বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টি নিয়ে দেখবে।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক নিপু বড়ুয়া তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, একটা সমিতির সাধারণ সম্পাদক এভাবে আড়ালে চলে যাবেন— এটা কখনই কাম্য না। চলচ্চিত্র ও শিল্পীদের স্বার্থে অভিনেতা ডিপজলকে দরকার। কারণ, উনার মতো একজন প্রযোজক ও শিল্পীকে এই মুহুর্তে খুবই প্রয়োজন। এতে চলচ্চিত্রের উপকার হবে।
চলচ্চিত্র চিত্রগ্রাহক সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মজনু বলেন, ডিপজল ভাই আড়ালে না থাকলে অন্তত তিনটি সিনেমার কাজ চলতো। আর এতে করে অনেকগুলো মুখে খেয়ে পড়ে বাঁচতো। ইন্ডাস্ট্রি কর্মব্যস্থ হতো। এখন এ দৃশ্যটা নেই। তাই সরকারের কাছে আবেদন তাকে সমহিমায় ফেরাতে সাহায্য করুন। ইন্ডাস্ট্রিকে ঢেলে সাজাতে তার মতো মানুষের দরকার আছে।
এদিকে, ডিপজলের অন্তরালে শিল্পী সমিতির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সিনিয়র বিনোদন সাংবাদিকরা। তাদের ভাষ্য- ডিপজল ইস্যুতে যেকোনো ভাবেই হোক তাদের সরব হওয়া উচিৎ ছিলো শুরুতেই। এর মানে হচ্ছে সেখানে ডিপজলের অনুপস্তিতিতে নেতৃত্ব সংকট। মনে ভয় নিয়ে একজন শিল্পী কখনই বিপদ অতিক্রম করতে পারে না। স্বচ্ছতা আর ব্যক্তিত্ব একজন শিল্পীর বড় গুণ, যা এই কমিটিতে থাকা অধিকাংশের কতটুকু আছে সে প্রশ্নও তোলেন সিনিয়র বিনোদন সাংবাদিকরা।
বিডিসংবাদ ডটকম