Image description
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ » উচ্চকক্ষের আলোচনা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব বিএনপির । » সংখ্যানুপাতিকে উচ্চকক্ষের প্রস্তাবে অনড় জামায়াত - এনসিপিসহ ২০ টির বেশি দল । » আগামী সপ্তাহের সংলাপে সিদ্ধান্ত জানাবে কমিশন ।

বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান , দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা- সম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আইন সভায় উচ্চকক্ষের প্রবর্তনের কথা বলা আছে বিএনপির ৩১ দফায় । জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া অন্য দলগুলোও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে । কিন্তু জট লেগেছে উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে । এ নিয়ে কমিশনে চার দিন আলোচনা করেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসা যায়নি । এ অবস্থায় উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনা পরিত্যক্ত ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি ।

একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার সংলাপ চলাকালে দুপুর ১২ টার পর বিএনপির পক্ষ থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে উচ্চকক্ষের আলোচনা পরিত্যক্ত ঘোষণার প্রস্তাব দেওয়া হয় । জবাবে কমিশন তাদের ‘ নোট অব ডিসেন্ট ' দিতে বলেছে । রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে গতকাল ১৪ তম দিনের আলোচনা হয় । আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ । সংলাপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ দলই উচ্চকক্ষ প্রবর্তন একমত হলেও সেটির নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে দেখা দেয় মতভিন্নতা । উচ্চকক্ষ ছাড়াও দুটি বিষয় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে মতের বড় অনৈক্য থেকে গেছে অন্য দলগুলোর । এর একটি হলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগ প্রক্রিয়া , অন্যটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা । 

জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগ কীভাবে হবে তা সংবিধানে নির্ধারণ করে দেওয়ার পক্ষে । কিন্তু বিএনপি এটি চাইছে না । অন্য দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে চাইলেও বিএনপির এতে সাড়া নেই । এ অবস্থায় বেশির ভাগ দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে কমিশন একটি মতামত দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে । বিএনপিসহ সমমনা পাঁচটি দল নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করেছিল । কিন্তু জামায়াতে ইসলামী , এনসিপি , ইসলামী আন্দোলনসহ ২০ টির বেশি দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি উচ্চকক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাবে অনড় । এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি উচ্চকক্ষসংক্রান্ত আলোচনা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । অনানুষ্ঠানিকভাবে কমিশনকে উচ্চকক্ষের আলোচনা ‘ পরিত্যক্ত ’ ঘোষণার প্রস্তাব করেছে দলটি । 

তবে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে , আগামী সপ্তাহের সংলাপে উচ্চকক্ষ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে । জানা গেছে , বিএনপি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ নির্বাচনের প্রস্তাবে অনড় থাকবে । যেহেতু উচ্চকক্ষ প্রবর্তনের প্রস্তাবটি বিএনপির ৩১ দফায় ছিল , তাই দলটি প্রকাশ্য এ নিয়ে বিরোধিতা করবে না । কিন্তু প্রস্তাবটি নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে তারা আর অংশও নেবে না ।

উচ্চকক্ষ নিয়ে বিএনপির অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করে গতকাল জামায়াতে ইসলামের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, কোনো একটি দল বা তিনটি দল না চাইলে আটকে ( উচ্চকক্ষের প্রস্তাব ) যাওয়াটা অবিচার ( ইনজাস্টিস ) হবে, বৈষম্য হবে । কারণ অধিকাংশ তো পক্ষেই আছে । কোনো এক জায়গাতে একটা সমাধান (সলিউশন) দিতে হবে । এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন অভিযোগ করেন , বিএনপি ও তার মিত্ররা পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করছে এবং এই প্রশ্নটিকে আলোচনা থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে আমরা কোনো ছাড় দেব না ।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর কাছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব দিয়েছিল, যার নিম্নকক্ষ নির্বাচিত হবে আসনভিত্তিক তথা বিদ্যমান নিয়মে এবং উচ্চকক্ষ হবে ভোটের সংখ্যানুপাতিক ( পিআর ) হারে । ঐকমত্য কমিশনের এই প্রস্তাব নিয়ে গতকাল মঙ্গলবারসহ মোট চার দিন আলোচনা করা হয় । সিপিবি ও বাসদ ছাড়া সংলাপে অংশ নেওয়া বাকি ২৮ টি দল ও জোটের পক্ষ থেকে উচ্চকক্ষের পক্ষে একমত প্রকাশ করা হয় । তবে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা দেখা যায় । বিএনপি ও তাদের সমমনা এনডিএম , লেবার পার্টি , ১২ দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের পক্ষ থেকে নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের কথা বলা হয় । চার দিনের আলোচনায় দলগুলোর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি ।

জামায়াত , এনসিপি , ইসলামী আন্দোলনসহ বাকি ২১ দল সংখ্যানুপাতিকে উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করে । যার মধ্যে কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে বলা হয় সংখ্যানুপাতিকে না হলে উচ্চকক্ষের প্রয়োজন নেই , যেটা নিম্নকক্ষের রেপ্লিকা হবে । এলডিপি ৫০ আসন নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে , ভোটের সংখ্যানুপাতে করার প্রস্তাব করে । এখনই উচ্চকক্ষ চান না বলে গতকালের আলোচনায় জানায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ।

বিষয়টি নিয়ে গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিএনপি তার পুরোনো অবস্থানেই আছে ( নিম্নকক্ষের আসন অনুপাতে ) । গতকাল ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের আলোচ্য সূচি ছিল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংবিধান সংশোধন ও সংসদের নারী আসন । তবে শেষেরটি নিয়ে আলোচনা হয়নি ।

আলোচনায় জামায়াতের পক্ষ থেকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের কথা জানান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ । তিনি বলেন, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে । সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষেরও দুই - তৃতীয়াংশের মতের পক্ষে কথা বলেন তিনি । হামিদুর রহমান আজাদের বক্তব্যের পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ফ্লোর নেবেন কি না জিজ্ঞেস করেন সঞ্চালক মনির হায়দার । এ সময় সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন , ‘ সালাহউদ্দিন ভাই আগেও এ নিয়ে কথা বলেছেন । এ নিয়ে আমার সঙ্গে আলাদা করে তাঁর কথা হয়েছে । '

উচ্চকক্ষ নিয়ে গত তিন আলোচনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন , আলোচনার সারাংশ নিয়ে কমিশনকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে । এ নিয়ে কমিশনকে বুধ ও বৃহস্পতিবার আলোচনা করে রোববার উত্তর দিতে হবে । ' গতকালের সংলাপে দুপুরের বিরতির আগেই সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয় । কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয় , নিম্নকক্ষে দুই- তৃতীয়াংশ , উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা , সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট । নিম্নকক্ষে দুই - তৃতীয়াংশ , উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা , গণভোটের ব্যবস্থা না থাকা এবং উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিম্নকক্ষে দুই - তৃতীয়াংশ এবং সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট ।

আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন , উচ্চকক্ষ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংসদে দুই - তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে মনে হয় কারও কোনো দ্বিমত নেই । কিছু বিষয়ে গণভোট লাগবে । গণভোটের বিধান আদালতের মাধ্যমে ফেরত এসেছে । এর বাইরে কিছু সংযোজন বিয়োজন করা হবে কি না , তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে । জামায়াত তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত জানায় । জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন , বিদ্যমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে ।