Image description

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংকখাতে বড় ধরনের লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সরকার পতনের পর এ খাতের নানা ক্ষত বেরিয়ে আসে। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে দেশের ২৩টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

গত ডিসেম্বর শেষে ১৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল এক লাখ ৭১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। তবে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) মূলধন ঘাটতির পরিমাণ কমলেও ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে। মূলত গত ডিসেম্বরভিত্তিক ২৮টি ব্যাংকে ডেফারেল (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ পরিশোধে ছাড় বা বিলম্ব করার) সুবিধা দিয়েছে, যার ফলে ঘাটতির পরিমাণ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংকখাতে মূলধন ঝুঁকিজনিত সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক কাঠামো অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ শতাংশ থাকা উচিত। যদি ব্যাংকগুলোকে ডেফারেল সুবিধা দেওয়া না হতো, তাহলে এ খাতে মার্চ শেষে সিআরএআর ঋণাত্মক হতো ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত বছরের শেষে ব্যাংকখাতে সিআরএআর হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সিআরএআর হচ্ছে, একটি ব্যাংকের মূলধন ও তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের অনুপাত, যেখানে ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী সম্পদের হিসাব নির্ধারণ করা হয়।

চলতি বছরের মার্চ শেষে ছয়টি রাষ্ট্রমালিকানাধীন, ৯টি বেসরকারি ব্যাংক, সাতটি ইসলামি ধারার ব্যাংক এবং একটি বিদেশি ব্যাংকের সম্মিলিতভাবে এক লাখ ১০ হাজার ২৬০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ে, যা এযাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে চার লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ডেফারেল সুবিধা নেওয়ার পরও খেলাপির প্রভাবেই ২৩টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।

চলতি বছরের মার্চ শেষে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা যায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে (বিকেবি), যা ডিসেম্বরে ছিল ১৮ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় ঘাটতি বেড়েছে। রাষ্ট্র খাতের অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে মার্চ শেষে জনতা ব্যাংকের ঘাটতি হয়েছে ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এ ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পাওয়ায় ঘাটতি ব্যাপক আকারে কমেছে।

এছাড়া ডেফারেল সুবিধা পেয়েও অগ্রণী ব্যাংকেরে ঘাটতি বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক ডেফারেল সুবিধা পেয়ে ঘাটতি কমে চার হাজার ৪৭০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। বেসিক ব্যাংক সুবিধা পেয়ে ঘাটতি বেড়ে হয় তিন হাজার ৫০৬ কোটি টাকা । এর পাশাপাশি রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) দুই হাজার ৫১১ কোটি টাকার ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যাংকটি ডেফারেল সুবিধা নেয়নি।

ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ মূলধন ঘাটতি ইউনিয়ন ব্যাংকের। মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৫ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ডিসেম্বরভিত্তিক এ ব্যাংক ডেফারেল ‍সুবিধা নেয়নি ফলে ঘাটতি বেড়েছে।

এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সাত হাজার ৭৯০ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ছয় হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এক হাজার ৯৮০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে তিন হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এক হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংক ৫২১ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া সবকটি ব্যাংকই ডেফারেল সুবিধা নিয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের মার্চ শেষে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯ হাজার ২৯ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি সাত হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা থেকে কমে ছয় হাজার ৯৩৯ কোটি টাকায় নেমেছে। দুটি ব্যাংকই ডেফারেলের সুবিধা নিয়ে ঘাটতি কমিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও এবি ব্যাংক সুবিধা পেয়েও ঘাটতি বেড়েছে। মার্চ শেষে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে ছিল এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর এবি ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা।

এছাড়া ডেফারেল সুবিধা না পাওয়ায় পদ্মা ব্যাংকের চার হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা থেকে ঘাটতি বেড়ে পাঁচ হাজার ১৭১ কোটি টাকা হয়েছে। ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রিমিয়ার ব্যাংক, সীমান্ত ও ইউসিবি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি না থাকলেও মার্চ প্রান্তিকে ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যাংক তিনটি ডেফারেল সুবিধা নেওয়ার পর ঘাটতি দাঁড়িয়েছে যথাক্রমেÑএক হাজার ১৭১ কোটি, ২৬ কোটি এবং ৯৫৪ কোটি টাকা। সিটিজেন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৮৬ কোটি টাকা ও বিদেশি খাতের হাবিব ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬ লাখ টাকা।