Image description

একসময় দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল কৃষি খাত; কিন্তু যুগের পরিবর্তনে এই ধারার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখন দেশের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রেমিট্যান্স এখন গ্রামীণ অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগে মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা শাটডাউন ঘোষণা করেছিল। এতে দেশের রেমিট্যান্সে ধস নেমেছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্সের জোয়ার বইছে। চলতি মার্চে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্সের রেকর্ড হতে চলেছে। আর এতে ঈদবাজারে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। ১০ বছর ধরে তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। প্রথম দিকে তিনি একটি কোম্পানিতে চাকরি করলেও মালিকের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে ওই মালিকের তত্ত্বাবধানে তিনি এখন একটি দোকান পরিচালনা করছেন। আগে পরিবারের খরচ চলত বাবার কৃষি আয় থেকে। কিন্তু বৃদ্ধ বাবার সংসারে এখন প্রধান আয়ের উৎস প্রবাস থেকে পাঠানো মহিউদ্দিনের রেমিট্যান্স। প্রতি মাসে তিনি বাড়িতে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পাঠান। কিন্তু ঈদে বাড়িতে পারিবারিক অনুষ্ঠান আর ঈদ শপিংয়ের জন্য পাঠিয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ওই টাকা থেকেই ক্রয় করা হয়েছে পরিবারের সবার জন্য নতুন জামাকাপড়।

জানতে চাইলে মোবাইলফোনে মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ছোট বেলায় আমরা প্রতি ঈদের জামা-কাপড় কিনতে পারতাম না। বাবার স্বল্প আয়ের কারণে মন খারাপ হলেও এটাকেই মেনে নিতে হয়েছে। ১০ বছর আগে ধার-দেনা করে সৌদি এসেছি। এখন আমাদের পরিবার চলছে ভালোভাবেই।

 

শুধু মহিউদ্দিন নয়, কক্সবাজারের রাসেল আমিন, চট্টগ্রামের সবুজ ও নোয়াখালীর আবু আহমেদেরও একই অভিজ্ঞতা। জানতে চাইলে আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, পরিবারে একমাত্র উপার্জন করা ব্যক্তি আমি। সৌদি থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠালেই পরিবার তার সব খরচ চালতে পারে। মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠালেও ঈদের সময় শপিংয়ের জন্য একটু বেশি পাঠাতে হয়। এখানে আসার পর আমি বাড়িতে জমি কিনেছি। এবার বাড়িতে গেলে নতুন জমিতেই ঘর করার চিন্তা আছে।

 

দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ নানা খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে রেমিট্যান্সের অর্থ। যদিও বিনিয়োগে সঠিক পরিকল্পনার অভাব আছে বলে জানান অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কমাতে হবে প্রবাসী আয়ের লাগামহীন খরচ আর বাড়াতে হবে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ।

 

কুমিল্লার কালির বাজার ইউনিয়নের ধনুয়াখলা। নীরব শান্ত আর সমৃদ্ধিতে ভরা একটি আদর্শ গ্রামে রূপ নিয়েছে প্রবাসী আয়ে ভর করে। পুকুর ভরা মাছ আর বাড়ির উঠানে তরতর করে বেয়ে উঠছে কার্তিকের পুইয়ের ডগা। প্রবাসী আয়ে গ্রামগুলো কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সৌদি প্রবাসী শরফুদ্দিন মোটাদাগে তার বর্ণনাও দিলেন, ‘প্রবাসে থাকায় আমাদের গ্রামে একটা কাঁচা ভিটা ঘর পাবেন না। বহুতল আধুনিক বাড়ি ছাড়া কোনো বাড়ি নেই। বাজারে প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনদের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ আবার নিজ আত্মীয়দের নিয়ে যাচ্ছেন বিদেশে। সব মিলিয়ে আমাদের এলাকায় এখন খুব বেশি অসচ্ছল লোক নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স আসে ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা গত চার বছরের মধ্যে একক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; কিন্তু প্রশ্ন, দেশের রিজার্ভে ভূমিকা রাখা এই প্রবাসী আয়ের কতটা টেকসই ব্যবহার হচ্ছে স্থানীয় ও ব্যক্তি পর্যায়ে? অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রবাসীদের পাঠানো টাকার যুতসই বিনিয়োগে পরিকল্পনা থাকা দরকার।

গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, বিদেশে যারা কাজ করে তাদের আস্থা ফিরে এসেছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে তারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন; কিন্তু তাদের আস্থা ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দেশে যোগ্য সম্মান দিতে হবে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মরত রয়েছে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে। যার মধ্যে গত ১০ বছরেই কর্মসংস্থান হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৩ হাজারের মতো। অভিবাসীদের বড় অংশটি থাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। যেসব ১০টি দেশ থেকে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও সিঙ্গাপুর উল্লেখযোগ্য। এই ১০টি দেশ থেকে মোট প্রবাসী আয়ের ৮৯ শতাংশ আসে।

রেমিট্যান্সের প্রভাবে গ্রামাঞ্চলের ব্যবসায়ও বড় ধরনের প্রভাব তৈরি হয়েছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারি বাজারের অন্তত ৫ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় কালবেলার এই প্রতিবেদকের। তাদের প্রত্যেকেরই দাবি, গত ৫ বছরে তাদের বাণিজ্যের প্রসারের পাশাপাশি মানুষের রুচিগত পার্থক্যও দেখা গেছে। অর্থাৎ মানুষ এখন কম দামি ও খারাপ কোয়ালিটির পণ্য কেনা থেকে মুখ পিরিয়ে নিয়েছেন।

জানতে চাইলে রফিকুল্লাহ নামে একজন কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, ৫ বছর আগেও বেশি দামের জামা আনলে তা বিক্রি করা কঠিন হতো। এখন কম দামি জামা আনলে বিক্রি কঠিন হয়ে পড়ছে।

দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী সূচক প্রবাসী আয়। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে দেশের রিজার্ভ দিনকে দিন শক্তিশালী হলেও বাজেটে তাদের জন্য তেমন কোনো বরাদ্দ থাকে না। নগদ প্রণোদনা ছাড়া বর্তমানে প্রবাসীদের জন্য নামেমাত্র যেই বাজেট আছে, তা মূলত প্রবাসীদের জন্য নয়। সেটি ব্যয় হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব খরচের খাতে। প্রবাসীদের সরাসরি উন্নয়ন খাতে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ থাকে না। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্থনীতির বুনিয়াদ ধরে রেখেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৯৪ কোটি মার্কিন ডলার। এর আগে কোনো একক মাসে দেশে এত প্রবাসী আয় আসেনি। প্রবাসী আয়ের রেকর্ডের এই হিসাব গত বুধবার পর্যন্ত। এর পরের কয়েক দিনের প্রবাসী আয়ের হিসাব যুক্ত হলে মার্চ শেষে প্রবাসী আয় ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সরকারি সংস্থা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ২০ বছরের মধ্যে বিদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন ২০২৩ সালে। ওই বছর দেশ থেকে ১৩ লাখের বেশি কর্মী কাজের সন্ধানে বিদেশে গেছেন। এই ২০ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী বিদেশে গেছেন ২০২২ সালে। ওই বছর ১১ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন কর্মসংস্থানের আশায়। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০ লাখের বেশি কর্মী গেছেন গত বছর। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বিদেশে কর্মী গেছেন ১ লাখ ৬০ হাজার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৩-২৪ সালে বিদেশে যেসব কর্মী গেছেন, তাদের বড় অংশই এখন দেশে আয় পাঠাতে শুরু করেছে। এ কারণে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।