
গুঞ্জন আছে, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিয়ে আপত্তি থাকায় এবার ঈদে নতুন নোট বাজারে ছাড়া হচ্ছে না।
ব্যাংকগুলো সরবরাহ বন্ধ রাখায় ঈদের সামনে এসে বেড়ে গেছে নতুন নোটের দাম; এক হাজার টাকার সমপরিমাণ কিনতে বাড়তি গুণতে হচ্ছে ৪৮০ টাকা পর্যন্ত।
অন্যদিকে বাজারে নতুন নোট সরবরাহ করতে না পেরে ‘বিড়ম্বনায়’ পড়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি না থাকায় তারা নতুন নোটে কোনো লেনদেন করতে পারছে না।
রীতি মেনে দুই ঈদের সময় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও নিজেদের কাছে থাকা নতুন নোট বিনিময় করে।
এবারের প্রস্তুতিও তেমনই ছিল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৮০টি শাখা থেকে নতুন নোট বিনিময় করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপর ব্যাংকের শাখাগুলো সর্বোচ্চ ৬৫ লাখ টাকার নতুন নোট সংগ্রহ করে ভল্টে রাখে।
এরমধ্যে গত ১০ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে জনসাধারণের মাঝে নতুন নোট বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

দাম বেশি হওয়ায় এবার বিক্রি কমে গেছে নতুন নোটের। ফাইল ছবি।
ব্যাংকগুলোর শাখায় যেসব ‘ফ্রেশ’ নোট গচ্ছিত রয়েছে, তা বিনিময় না করে সংশ্লিষ্ট শাখায় সংরক্ষণ করতে বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। পুনঃপ্রচলনযোগ্য নোট দিয়ে সব নগদ লেনদেন কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।
নতুন নোট বিনিময় বন্ধ রাখার ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিতে কিছু বলা ছিল না। তবে গুঞ্জন রয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নিয়ে আপত্তি থাকায় এবার ঈদে নতুন নোট বাজারে ছাড়া হচ্ছে না।
হাজারে বাড়তি ৪৮০ টাকা!
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিজ্ঞপ্তিতের ফলে বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে থাকান নতুন নোট আটকে যায়; অন্যদিকে দাম বেড়ে যায় খোলা বাজারে।
রাজধানীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আশপাশ ছাড়াও গুলিস্তান, সদরঘাট, মিরপুর, ফার্মগেইট, রায়সাহেব বাজার এলাকাতে সারা বছর নতুন নোট কেনাবেচা হয়।
এসব এলাকায় এবার ১০ টাকার ১০০টি নতুন নোট বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪৮০ টাকা পর্যন্ত। অথচ গেল বছরও তা ১১৫০ থেকে ১১৮০ টাকায় মিলেছে।
ঈদে ৫, ১০, ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার নতুন নোটের চাহিদা থাকে বেশি। এ কারণে এসব নোটের দামও বেশি চান বিক্রেতারা।
মতিঝিলের নতুন ও ত্রুটিযুক্ত নোটের ব্যবসায়ী পাভেল রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংক তো টাকা দেয় না। গতবার যারা কুটি কুটি টাকা দিয়ে নতুন নোট নিয়া রাখছিল, তারাই এখন আমাগো দিতাছে।”
নতুন নোটের পসরা দেখিয়ে তিনি বলেন, “রেটও তারাই ফিক্সড করে দেয়। আমরা কমিশনে বিক্রি করি।”
একই এলাকার মোহাম্মাদ তাহের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১০ টাকার একটা বান্ডিল নিতে চাইলে বাড়তি ৫০০ টাকা চাই। মুলামুলি করে ৪৮০ টাকায় ছাইড়া দেই।
“গতবার তো দেড়শ-দুইশ টাকায় বিক্রি করছি এক বান্ডিল। এবার বেশি দাম, আমাগোও খারাপ লাগে; ব্যবসা মনে হয় খারাপ যাইব এবার।”
উচ্চমূল্য হওয়ায় নতুন টাকার বিক্রিও কমেছে। নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া কেউ কিনছেন না।
মতিঝিলে ১০ টাকার নতুন নোট কিনতে এসেছিলেন মুগদা এলাকার মাহমুদুজ্জামান। দরদাম করে প্রতি বান্ডিলে অতিরিক্ত ২৫০ টাকা দিতে চেয়েও কিনতে পারেননি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রতিবারই ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার নতুন নোট কিনি। গতবার ২০ হাজার টাকার নোট নিয়েছিলাম অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা দিয়ে। এখন তো দাম অনেক বেশি। পুরান টাকা দিয়ে ঈদে চলতে হবে এবার।”
মাহমুদুজ্জামানের মত অনেকেই দরদাম করে না নিয়ে চলে যাচ্ছেন। অনেকেই বান্ডিল ভেঙে ১০ থেকে ২০টি নোট নিচ্ছেন বাড়তি টাকা দিয়ে।
মতিঝিলের বিক্রেতারা বলেন, তারা সাধারণত বান্ডিল ভেঙে নতুন নোট বিক্রি করেন না। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় এবার করতে হচ্ছে।

গুলিস্তানের বিক্রেতা আবু হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন টাকা নাই আমাগো কাছে। গতবছর অনেক টাকা বেচা হয় নাই, সারা বছর তার মধ্যে থেকে কিছু বেচছি। এহন বাকিডা বেচতাছি।
“দাম আরও বাড়ব, এহন তো ৪৮০ টাকা দিলে ১০ টাকার এক হাজার পাইতাছেন। কত টাকায় ঠেকব, তা কইতে পারতাছি না।”
এবার ২০ টাকা মূল্যমানের নতুন নোটের প্রতি বান্ডিল (দুই হাজার টাকা) নিতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ৫০০ টাকা।
আর ১০০ টাকা মানের নতুন নোট নিতে প্রতি বান্ডিলে (১০ হাজার) গুনতে হচ্ছে ৩০০ টাকা। অতিরিক্ত ৪০০ টাকা লাগছে ৫০ টাকার বান্ডিলে (পাঁচ হাজার)।
ঈদের আগে ছেঁড়া-ফাটার বিনিময়ে নতুন নোট দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। কিন্তু এবার দেওয়া হচ্ছে পুরনো নোট।
গত বৃহস্পতিবার ধানন্ডির গ্রিন রোড থেকে এক হাজার টাকার ‘ত্রুটিযুক্ত’ নোট বদলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন খন্দকার এহসান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নোটের একটি সংখ্যার অংশ ছিড়ে গেছে। বদলে নিতে এসেছিলাম। ব্যাংক থেকে বলা হল, গত ১১ মার্চ থেকে নতুন নোট দিচ্ছে না। তাই পুরনো নোটই দিল।”
বিড়ম্বনায় অনেক ব্যাংক
নতুন নোট থাকারও পরও খরচ করতে না পারায় ‘বিড়ম্বনায়’ পড়েছে অনেক ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের মতিঝিলের এক শাখার ব্যবস্থাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৬৫ লাখ টাকা দিয়ে তো নতুন নোট এনেছি। এখন এই টাকা বিতরণ করলে পুরনো নোট পেয়ে যেতাম, তা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেবা ঠিখ রাখা যেত। আর এটিই করে আসছি সব সময়।
“এবার তো টাকা আটকে গেল, জায়গাও দখল করেছে; টাকা কোনো কাজে আসছে না। ব্যাংকের তো লস। ব্যাংক তো টাকা খাটাবে, ব্যবসা করবে।”
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের ভল্টে নতুন নোট রাখার জায়গা না থাকলে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যখন যে ব্যাংক সমস্যার কথা বলবে, তৎক্ষণাৎ তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসা হবে।”
অন্য ব্যাংকগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদের নতুন নোট ব্যাংকেই থাকবে; বাজারে ছাড়বে না। নতুন করে ছাপানো নোট পাঠানোর পরিবহনে সেগুলো ফিরিয়ে নেওয়া হবে।”

ঈদে ৫, ১০, ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার নতুন নোটের চাহিদা থাকে বেশি।
বাংলাদেশের অনুমোদিত মুদ্রার বিনিময় করতে অতিরিক্ত কোনো ফি, চার্জ বা অর্থ নেওয়া দণ্ডনীয়। তবে ফুটপাতসহ বিভিন্ন স্থানে সারাবছরই সবার সামনে নতুন টাকার কেনা-বেচা চলে।
বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানোর কাজটি করে দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড, যা টাকশাল নামে পরিচিত। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা পেলেও ১৯৮৮ সালের জুন মাসে এক টাকা ছাপানোর মধ্য দিয়ে এ প্রেসের নোট ছাপানো শুরু হয়।
ওই বছরের নভেম্বর মাসে ১০ টাকার নোটও ছাপানো হয় সেখানে। প্রতিটি নোট ছাপানোর আগে এর নকশা অনুমোদন করে সরকার। সেজন্য দরপত্র ডেকে চিত্র শিল্পীদের দিয়ে নোটের নকশা করানো হয়।
নকশা চূড়ান্ত হলে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কাগজ, কালি ও প্লেট তৈরি করা হয়। নকশা অনুযায়ী বিদেশ থেকে প্লেট তৈরি করে আনার পর ছাপার কাজটি করে টাকশাল।
সবশেষ নতুন নকশায় ২০০ টাকার নোট চালু হয় ২০২০ সালে। ওই নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবিতে নতুন রূপ দেওয়া হয়।
আগে ছাপানো নোটে ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধুর ছবি বাদ দিয়ে আরো স্পষ্ট করে দুই ধরনের ছবি ব্যবহার করা হয় ২০২০ সাল থেকে। এরপর ছাপানো সব নোটে ওই দুই ধরনের ছবিই ব্যবহার করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাড়া সবশেষ নোট ছাপা হয়েছিল ২০০৯ সালে। তখন গভর্নরের দায়িত্বে থাকা সালেহ উদ্দিন আহমেদ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। ওই সময় ছাপা লাল রঙের ৫০০ টাকা এবং এক হাজার টাকার কিছু নোট এখনো দেখা যায়।